India-USSR Treaty

৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

ভারত-USSR চুক্তি

.

ইন্দিরা-Kosygin যৌথ বিবৃতির অংশটি বিশেষ করে যেটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত করার কথা বলা হয়েছে। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ যে “বাংলাদেশ” শব্দটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। যদিও ইন্দো-সোভিয়েত জোটের সমালোচকরা এর মধ্যেই এই এড়িয়ে যাওয়ায় হিসাব নিকাশ শুরু করে দিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই  বিবৃতি একটি সুদূর প্রসারী ফলাফলের দলিল হয়ে থাকবে। দিল্লীর শক্তিবৃদ্ধি নিয়ে প্রেসিডেন্ট পদগর্নির পরবর্তী বক্তব্য এই আশাকে আরো জোরদার করে। বিবৃতি উদ্ধৃতির মাধ্যমে আমি বিশ্লেষণ করছিঃ

“২৫ মার্চ ১৯৭১ থেকে পূর্ব বাংলার অবস্থার উন্নতির বিষয়ে উভয়পক্ষের শান্তি রক্ষার দাবি বিবেচনা করে সমস্যাগুলোর দ্রুত রাজনৈতিক সমাধানে যেগুলো উঠে এসেছে, ইচ্ছার মর্যাদা দেওয়া, পূর্ব বাংলার মানুষের প্রাপ্য অধিকার ও আইনগত সুবিধার পাশাপাশি রিফিউজিদের তাদের মাতৃভূমিতে সম্মান ও মর্যাদা সহকারে দ্রুততম ও সুরক্ষিত ফেরা নিশ্চিত করা।”

অন্যভাষায়, যেকোন সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের উল্লেখ হয়েছে এখানে। জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও আইনগত অধিকার বলতে এখানে ডিসেম্বর ৭০ এর নির্বাচনের ফলাফলকে বোঝানো হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে স্বাধীনতার কম কিছু গ্রহনযোগ্য নয়। অন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল যা খুবই ইউনিক যে  বিবৃতিটিতে স্বাক্ষর করেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রী এবং সোভিয়েত কম্যুনিষ্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি।

আমার মতে সোভিয়েত প্রিমিয়ারের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য হল “অভ্যন্তরীণ বিষয়” অংশটি। এটিকে যদি পৃথকভাবে দেখা হয় তাহলে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু যেহেতু বিবৃতিটিকে সার্বিকভাবে বিবেচনা করতে হবে, সোভিয়েত ইউনিয়ন সমস্যাটিকে আন্তর্জাতিক ইস্যু হিসেবে বিবেচনা করে। এরকম একটি অবস্থায় সোভিয়েত নেতা “অভ্যন্তরীণ বিষয়” বলতে কি বুঝিয়েছেন? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিচ্যুত করার একমাত্র উপায় হল আন্তর্জাতিকভাবে ভ্রান্তি ছড়ানো। এই অর্থে ধরা যাক ভিয়েতনামের কথা। এটিকে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে  ধরা হয়েছে কারণ যুদ্ধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যোদ্ধা ও ইসলামাবাদ জেনারেলদের মধ্যে হচ্ছে। এটি আমাদের যুদ্ধ। এটি বাঙ্গালী জাতির একার- এবং অন্য কোন জাতি অবশ্যই চলমান যুদ্ধে যুক্ত হবে না। আমরা কিছু বন্ধুপ্রতীম দেশ যেমন ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নির্ভর করতে পারি যেন আন্তর্জাতিক ভাবে এখানে নাক না গলানো হয়। অন্য বন্ধু ও শুভাকাংখীদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে “হস্তক্ষেপ না করা” ছিল ভিয়েতনামীদের অবস্থান এবং সোভিয়েত ও ভিয়েতিনামের মধ্যেও। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের  বিদেশী শক্তির সংযুক্তি ঠেকাতে না পারাই এই সমস্যার দীর্ঘসূত্রতার সরাসরি কারণ ছিল।

এই ক্ষেত্রে, আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুপস্থিতি নোট করব। বিশেষভাবে অনুপস্থিত ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সহানুভূতি যা দুই দেশই অনুভব করে। এরকম কিছুর উপস্থিতি ফ্যাসিস্ট ইসলামাবাদের সাম্রাজ্যবাদী রক্ষকদের বাংলাদেশে সরাসরি যুক্ত হওয়ার সুযোগ দিত। এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে ইন্দিরা অথবা Kosygin এর কেউই বিজয়ী স্বাধীনতাকামী সেনা দেখতে চান না। যে কারো মনে থাকবে যে ভিয়েতনামে যখন শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান দাবি করা হচ্ছিল সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্রশস্ত্র ভিয়েতনামীদের জোগান দিয়েছিল।

বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের ভোটে নির্বাচিত বৈধ জনপ্রতিনিধিদের সমর্থিত যৌথ বিবৃতিতে দেয়া রাজনৈতিক সমাধানের তীব্র বিরোধিতা কেউই করেনি।

কিন্তু এই জনপ্রতিনিধিরা ইসলামাবাদের সাথে সম্মতির জন্য কিছু নূন্যতম শর্ত ঘোষনা করেছে এবং এগুলো হল – বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে মেনে নিতে হবে এবং শেখ মুজিবুর রহমান এবং দখলকৃত এলাকায় যে সকল রাজনৈতিক বন্দীদের নির্যাতন করা হচ্ছে ও আতংক ছড়ানো হচ্ছে তাদের নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। এই নূন্যতম শর্তগুলোই আমাদের শর্ত, কোন আদর্শের জন্য নয়, শুধুই বেচে থাকার জন্য। এই নূন্যতম শর্তগুলো যতক্ষণ না পূরণ হচ্ছে আমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নাই যেমনটা ফরাসী মুক্তিযোদ্ধা, লেখক এবং সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী Andre Malraux বলেছেন, এবং আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাব। আমাদের ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ অন্যান্য বন্ধুপ্রতিম দেশের মহান নেতৃত্বের উপর পূর্ণ আস্থা রয়েছে যে তারা তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের নামে  কিছু ক্ষমতাশালীদের জন্য জাতীয় স্বার্থের নামে  কোন প্রকার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে না। পাকিস্তানের ২৫ মার্চের পূর্ববর্তী আমাদের অধিকাংশই প্রকাশ্যে বলেছিল যে পাকিস্তানের কৃত্রিম মিলনের পথ সেই বিশেষ দিনটি থেকে বন্ধ হয়ে গেল যেদিন কিছু উন্মাদ, দুঃখবাদী এবং ক্ষমতালোভী জেনারেলরা এবং তাদের পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিক কোলাবোরেটররা অধিকাংশ জনগণকে অপরিসীম ভয়াবহতা ও পৈশাচিকতার দিকে ঠেলে দেয়। কোনকিছুই এই দ্যর্থ ঘোষনার থেকে অধিক নৈতিক ও সঠিক হতে পারে না। যদি এখনো কিছু পরাশক্তি মনে করে যে তারা নিজেদের স্বার্থে পাকিস্তান ফ্রেমওয়ার্ককে বাচিয়ে রাখতে পারবে তাহলে তারা খুব বড় ভুল করছে। তাদের কাছে আমাদের একটাই চাওয়া- আমাদের ব্যাপারে নাক গলাবেন না, আমাদেরকে আমাদের মত থাকতে দিন। কোন দলেই অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করে বিঘ্ন ঘটাবেন না। আপনারা যদি এগুলো করতে পারেন তাহলে আমরা প্রতিজ্ঞা করছি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা সমাধানে পৌছাবো- যদি সত্যিই আপনারা এটা চেয়ে থাকেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের অতি বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্রগতিকে কোনরূপ বাধা না দিয়ে পাকিস্তানকে লেভারেজে রাখছে। তারা তাদের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে ইসলামাবাদকে বাংলাদেশ ছাড়ার ব্যাপারে একটি সম্মতিতে আসতে বাধ্য করতে পারে। এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে ছয় মাসের আত্নহত্যাসম যুদ্ধের পর ইসলামাবাদ অর্থনৈতিকভাবে খোড়াচ্ছে না। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী তারা আর কোন লোন দিবেনা। মিলিটারিরও দৃশ্যগত অবস্থা একই রকম।

সবশেষে, দখলকৃত এলাকায় এবং বিদেশে আমাদের জনগণের প্রতি সতর্কবার্তা। পরাশক্তিদের দ্বারা সাহস পাওয়া এবং অর্থনৈতিক সাহায্য পাওয়া শক্তিগুলো যারা বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন নয় তারা যোদ্ধা এবং তাদের প্রতি সহানুভুতিশীলদের প্রতি ধোয়াশা তৈরি করতে পারে। কেউ কেউ আরো আগ বাড়িয়ে বলছে যে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি আর্মির বিরুদ্ধে আমরা খুবই অপ্রতুল, এবং এভাবে আমরা তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানে সম্মত হচ্ছি। এখন পর্যন্ত গত ছয় মাসের অনবরত যুদ্ধ দেখিয়েছে যে আমাদের শত্রু আধুনিক ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং অস্ত্র সজ্জিত হলেও তারা আমাদের থেকে ৪০ গুণ বেশি সৈনিক হারিয়েছে। এটা কি অলৌকিক? অবশ্যই না। এরূপ বিস্ময়কর জয়ের কারণ কি? মানুষের সমর্থন, আমাদের যুদ্ধকৌশলে আমাদের ১ম শ্রেণীর স্বতঃস্ফুর্ততা এবং বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও দেশপ্রেমের জোরে এগিয়ে যাওয়া আমাদের সিংহরা। বিজয় আমাদেরই- কারণ শুধু এটি ই নয় যে আমরা চাই বরং এটি ইতিহাসের বিচার।

Scroll to Top