Causes of Arab Apathy Toward Bangladesh

১৩ জুলাই, ১৯৭১

বাংলাদেশের প্রতি আরব বিশ্বের নিঃস্পৃহতার কারনসমুহ

.

দুর্ভাগ্য যখন আসে সদলবলেই আসে- শেক্সপিয়ারের প্রবাদ, কিন্তু কেউ ভাবতেও পারেনি প্রকৃতি বাংলাদেশের মানুষকেই বেছে নেবে প্রবাদের সত্যতা প্রমানে, শতাব্দীতে মাত্র একবার হলেও। নুন্যতম হৃদয় আছে এমন কেউ কখনো চাইবে না মাত্র দুইমাস আগে নেমে আসা প্রায় বিশলক্ষ প্রাণ হরণকারী শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ংকর সাইক্লোনে টালমাটাল জাতির ওপর এমন বীভৎস ধ্বংসযজ্ঞ নেমে আসুক। কিন্তু তাই হয়েছিল এবং সমস্যা আরো বাড়িয়েছিল আন্তর্জাতিক নিঃস্পৃহতা বিশেষত পরাশক্তিদের যাদের ক্ষমতা ছিল সভ্যতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি জান্তার এই উন্মত্ত, ঘৃণ্য অপরাধ থামানোর। এবং তাও যেন যথেষ্ট ছিলনা, শীঘ্রই বাঙ্গালিরা শুনতে পেল কিছু আরব সরকারের কাছে খুনি জান্তার পাশবিক অপরাধের নিন্দা করা দূরে থাক বিপন্ন মানবতার প্রতি সহানুভূতি জানানোও কঠিন মনে হচ্ছে। এরকম বীভৎস বিরোধীতা খুনি জান্তার সাথে নিক্সন প্রশাসনের প্রকাশ্য আঁতাতের চেয়েও মনোবেদনা জাগায় কারন শেই সুয়েজ সংকট থেকে শুরু করে বাঙ্গালীরা কখনোই আরবদের পাশে দাড়ানোর সুযোগ হাতছাড়া করেনি যদিও পাকিস্তানি শাসকের সবসময়ই সন্দেহজনক নীতি অবলম্বন করে চলত যা আসলে আরব স্বাধীনতার বিপক্ষের ষড়যন্ত্রকেই সাহায্য করে। প্রেসিডেন্ট নাসের যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন এটা ভোলেননি। যখনই পাকিস্তান থেকে কেউ তার কাছে আসত তিনি সেই সোফাটা দেখাতেন যেখানে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বসেছিলেন  সুয়েজ খালকে মিসরের রাষ্ট্রীয়করনের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ আগ্রাসনের প্রতি তার সরকারের সমর্থন জানানোর জন্য লন্ডন যাত্রার প্রাক্কালে। কিন্তু নাসেরের বিদায়ের পরেই পরিস্থিতি আমুল বদলে যায়। যাহোক সেপ্রসঙ্গে আমরা পরে আসব।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম নিয়ে আরব প্রতিক্রিয়ার ঘটনাগুলোকে আমার তুলে ধরতে হবে।  আমাদের জন্য সবই অন্ধরাচ্ছন্ন নয়। আমাদের চিনতে হবে কারা পাকিস্তানের প্রতি মৌন সমর্থন জানাচ্ছে আর কারা জানাচ্ছে না। সৌদি আরবের সরকার প্রথম পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ায়।তাকে অনুসরন করে মরুর কিছু মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্র। এসব সরকারকে সরাসরি দোষ দিতে আমরা তাড়াহুড়ো করতে পারিনা কারন আমাদের ভাবতে হবে কেন এবং কি স্বার্থে তারা এমন জনগোষ্টীর উপর হামলাকে সমর্থন করে যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠই ধর্মভীরু মুসলিম। পাকিস্তানের সমর্থনের আবেদনে তাদের প্রতিক্রিয়া মোটামুটি স্বাভাবিকই ছিল।

সম্পুর্ন সামন্ততান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির এইসব রাজতন্ত্রের সাধারন জনগণের গনতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি কোন চিন্তা বা সহানুভূতি ছিলনা। এসব দেশের সধারন জনগণ ভুমিদাসত্বে বাস করত এবং সম্ভবত দুনিয়ার সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থায় ছিল। এসব সরকারকে পাকিস্তানি জান্তার ধর্মীয় ছদ্মবেশই নাড়া দিয়েছিল। আর যেহেতু সত্যগুলো দেখিয়ে দেয়ার মত বাঙ্গালী কমই ছিল সেহেতু পাকিস্তানি সরকার খালি ময়দান পেয়েছিল এবং এসব রাজতন্ত্রকে বিশ্বাস করিয়েছিল যে বাংলায় ইসলাম বিপদে আছে এবং এখাঙ্কার মুসলিম জনগোষ্ঠী দ্রুত অমুসলিম হয়ে যাচ্ছে এবং হিন্দুনিয়ন্ত্রিত ভারতের সাথে যুক্ত হতে চেষ্টা করছে। পাকিস্তান তাদের বিশ্বাস করিয়েছিল যে তাই তার পুর্ববাংলায় জেহাদ শুরু করে ইসলামকে রক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলোনা। এটা ছিল খুব সহজেই তৈরি এক টোটকা এবং পুর্ব বাংলা সম্পর্কে অজ্ঞ রাজা-বাদশারা আরো সহজে তা হজম করে নেয়। এমন কেউ ছিল না যে এই স্বঘোষিত ইসরমের রক্ষকদের কোরআন ও সুন্নাহ বিরোধী জীবন যাপন ও ক্ষমতার দখলদারী তুলে ধরে। এমনকি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরা যে আসলে হাজারে হাজারে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের মেরে তাদের উপাসনার স্থান ধ্বংস করে ফেলছে শুধু পাকিস্তানি সামরিক-পুজিবাদী-আমলা গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শোষণের ইতি টানতে বাঙ্গালির প্রতিজ্ঞাকে ধ্বংস করার জন্য এটা বলারও কেউ ছিলোনা। সৌদি পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের ধারেকাছে যায়নি এমন লোকদের মাধ্যমে ইয়াহিয়ার প্রেস রিলিজ দিয়ে পাকিস্তানপন্থী প্রবন্ধ ছাপাচ্ছিল যা থেকে রাজতন্ত্রীদের মনোভাব বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু কেন আরব সোশ্যালিজম এর পতাকাবাহীরা বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে গেল যার কিনা সবসময় তাদের পাশে ছিল? পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞ অনুমোদন দিয়ে তো তাদেরও কিছু পাওয়ার নেই। বিশ্বের জাতীয় মুক্তিকামী সাধারন মানুষের প্রতি তাদের ঘোষিত সংহতির তাহলে কি হল? আসলে আগে যেমনটা বলছিলাম নাসেরর বিদায়ের পরে আরব সমাজতন্ত্রে মৌলিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। ইউএআর স্পস্টতই ডানপন্থী প্রতিক্রিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ছে।এই অবস্থার পক্ষে যুক্তি হিসেবে দেখান যায় সাদাত সরকারের মধ্যপন্থী সমাজত্নত্রীদের ওপর দমন-পীড়ন এবং মুসলিম ব্রাদারহূড, পাকিস্তানি জামাত-ই-ইস্লামির মিসরীয় রুপ,এক ভয়ংকর গোষ্ঠী যাদেরকে নাসের স্বয়ং শক্ত হাতে দমন করেছিলেন তাদের প্রতি তোষনের নীতিকে। মিসর প্রভাবিত রাষ্ট্র যেমন সিরিয়া এবং লেবাননেও একইরকম ধারা ছিল। তাই রাজতন্ত্র নেই এমন সরকারগুলোর মনোভাবও রাজতন্ত্রী সরকারগুলোর মত ছিল কারন তারাও ইসলামের নামে পাকিস্তানি ধোকায় অন্ধ হয়েছিল।

কিন্তু অজ্ঞতা ও গোঁড়ামির এই অন্ধকার পরিবেশেও আলোর ঝলকানি এসেছিল আরব বিশ্বের মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে যারা একইসাথে দুই শত্রু বাইরের ইসরায়েল ও ভিতরের রাজতন্ত্রের সাথে লড়াই করছিল। আল ফাত্তাহ এবং ইপিএলপির মত প্যলেস্টাইনি কমান্ডো সংস্থাগুলো যারা জর্দানে পকিস্তানি সৈন্যসমৃদ্ধ হুসেইনের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছিল তারা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সংহতি জানিয়েছিল।আমি নিশ্চিত বাংলাদেশ এবং ফিলিস্তিনি জনতার দুর্ভোগের সাদৃশ্য যদি আরব জনতার কাছে তুলে ধরা যেত তাহলে সমগ্র আরব বিশ্ব পাকিস্তানের অপরাধের কথা জানত এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে বাংলাদেশের প্রতি তাদের সংহতি জানাত।

Scroll to Top