British Labor Party Wakes up: UN Intervention

৫ অক্টোবর, ১৯৭১

বৃটিশ লেবার পার্টির জাগরণ: জাতিসংঘের মধ্যস্থতা এখনই আমন্ত্রিত নয়

অবশেষে বৃটিশ লেবার পার্টি বাংলাদেশ বিষয়ক সমস্যাকেন্দ্রিক অঙ্গীকারের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। পার্টির জাতীয় কার্যনির্বাহী সম্পাদক কর্তৃক প্রস্তুতকৃত এক বক্তব্যে বাংলাদেশে চলমান সামরিক অবরোধের অবিলম্বে অবসান এবং বাঙালী রাজনৈতিক নেতা বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির আহ্বান জানানো হয়। বাংলাদেশের জনগণের বিষয়ে কোন গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে পাওয়া না পর্যন্ত সাহায্য সংস্থা “এইড-পাকিস্তান” এবং অন্যান্য সকল দেশকে এই নিন্দিত সামরিক সরকারকে সকল প্রকার সহায়তা প্রদান স্থগিত করার আহ্বানও এই বক্তব্যে জানানো হয়। জাতিসংঘকে এ বিষয়ের সমাধান অনুসন্ধানে আরো সক্রিয় হবার দাবীও এতে জানানো হয়।

চলতি সপ্তাহে ব্রাইটনে অনুষ্ঠিত লেবার পার্টির বাৎসরিক সম্মেলনে এই বক্তব্য উপস্থাপন করা হবে। পরবর্তী বৃহস্পতিবার এ নিয়ে বিতর্ক হবে এবং নেতৃত্বের মতামত সাধারণ পরিষদে সমর্থিত হবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন।

এটা অবশ্যই একটা তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি। কারণ জন স্টোনহাউস, পিটার শোর এবং পার্টির অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সদস্যদের অটল তদবির এবং কূটনৈতিক চাল সত্ত্বেও পার্টি প্রধান হ্যারল্ড উইলসন বাংলাদেশের উপর পাকিস্তানি অপরাধমূলক কর্মকান্ডের ব্যাপারে মুখে কুলূপ এঁটে ছিলেন। আপাতদৃষ্টিতে এই আকস্মিক প্রতিশ্রুতির পিছনে নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। একটি বিষয় এখানে নিশ্চিত যে, বাংলাদেশ এখন তার অস্তিত্ব সারাবিশ্বে অনূভব করাতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ অন্যান্য কিছু দেশ যেমন গ্রীস, স্পেন আর নাইজেরিয়ার মত শুধুমাত্র “আভ্যন্তরীন বিদ্রোহ” -এর কোন ঘটনা নয়। এই উপলব্ধি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় রাজধানীসমূহের সর্বশেষ প্রতিক্রিয়ায় লক্ষণীয় যারা এতদূর পর্যন্ত নিরপেক্ষ অবস্থানে ছিল। দৃঢ় বাস্তবতায় লেবার পার্টির জাগরণ নিশ্চিতভাবেই পরিবর্তনের ক্রমবর্ধমান হাওয়াকে নির্দেশ করে, যদিও এটির গঠনে সময় লেগেছিল দীর্ঘ ছয়টি মাস। বেশ কিছুসংখ্যক ব্রিটিশ এমপির অভিমত ছিল যে উপমহাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে বৃটেনের অনন্য দায়িত্ব রয়েছে। যেহেতু বৃটেন ১৯৪৭ সালে ভারতীয় সাম্রাজ্য বিভাজনে তত্ত্বাবধায়কের ভুমিকায় ছিল, সেহেতু তারা যেকোন বিশৃঙ্খল অপ্রাকৃত বিভাজন অথবা অনুবর্তী কৃত্রিম ঐক্যের ব্যাপারে সরাসরি দায়ী। বাংলাদেশের মানুষের উপর ইসলামাবাদ-জান্তার ঔপনিবেশিক, বর্ণবাদী এবং ফ্যাসিবাদী আক্রমণ পরিস্কারভাবে সূচিত করে যে, উপমহাদেশের ব্রিটিশ মদদপুষ্ট বিভাজন মোটেই কাজ করছে না। স্পষ্টতই, উপমহাদেশের দীর্ঘস্থায়ী এবং শান্তিপুর্ণ রাজনৈতিক সাম্যাবস্থা নিশ্চিত করার জন্য সীমানারেখা নতুন করে আঁকতে ও সাজাতে হবে। নতুন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে উপমহাদেশের মানচিত্রে সম্মানজনক অবস্থানে থাকতে হবে।

লন্ডন এই সংঘর্ষ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারত। যথাসময়ে সক্রিয় থেকে এডওয়ার্ড হেলথ এর রক্ষণশীল মন্ত্রণালয় পাকিস্তানি বুলেটের শিকার হাজার হাজার নিরীহ মানুষের জীবন বাঁচাতে পারত এবং দেশান্তরের কারণে ভারতের উপর যে বিপুল চাপ পড়েছিল তা ব্যাপকভাবে হ্রাস করতে পারত। কিন্তু ব্রিটিশ পররাষ্ট্রসচিব স্যার অ্যালেক্স ডগলাস হোম ইতিবাচক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন।

সম্ভবত এই ব্যর্থতাই লেবার পার্টিকে উদ্যোগটি আয়ত্ব করতে উৎসাহী করে। যেহেতু বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমানভাবে একটি  তাৎপর্যপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিষয় হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে, সেহেতু এটি বৃটিশ এবং আমেরিকান নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করবে। অন্ততপক্ষে, শ্রম নেতৃত্বের আমাদের পক্ষে চলে আসার কারণ যেটাই হোক না কেন, বাংলাদেশের জনগণ হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে জন স্টোনহাউস এবং পার্লামেন্টের সেইসকল লেবার সদস্যকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করবে, যারা বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছেন। বাংলাদেশের ব্যাপারে লেবার পার্টির দ্বিধা তাদের কূটনীতির কারণেই সমাপ্ত হয়েছিল।

বাংলাদেশে জাতিসংঘের সম্পৃক্ততার ব্যাপারেও আমরা অকপটে সন্দেহবাদী ছিলাম। এমনকি বিশ্বের চতুর্দিক থেকে উত্থিত গণহত্যার অভিযোগ জাতিসংঘ বিভীষিকাময় হত্যাযজ্ঞের ছয়মাস পরেও তদন্তে ব্যর্থ হয়। যখন ইয়াহিয়া খান গর্বের সাথে পূর্ব পাকিস্তানে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়ার মাধ্যমে তার পূর্বপুরুষ নাদির শাহকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টায় ছিল, তখন এটি সম্পুর্ণ নিশ্চুপ দর্শক হয়ে ছিল। কার্যত, এর পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতার কারণে ইয়াহিয়ার বাংলাদেশের স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীনতা যুদ্ধকে দমন করার যে নির্মম আশাহীন চেষ্টা ছিল, সেটিতেও হস্তক্ষেপের বিভিন্ন উপায় উদ্ভাবন করে। বাংলাদেশের জনগণ এবং তাদের আন্তর্জাতিক বন্ধুমহল অটলভাবে এবং সাফল্যের সাথে এটিকে প্রতিহত  করে। এমনকি আজকেও জাতিসংঘ বাংলাদেশ এবং ইসলামাবাদের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যকার বিরোধিতা হিসেবে দেখছে। এই অবস্থান বাংলাদেশের জনগণের জন্য  সুনিশ্চিতভাবে ক্ষতিকর এবং জনবিরোধী, কারণ ২৬ মার্চ ইয়াহিয়ার স্বীকারোক্তির সময় থেকে এটি ছিল পাকিস্তানি রটনারই বীর্য।

বিশ্বশান্তি ও দক্ষিণ এশিয়ার শান্তির স্বার্থে এবং বাংলাদেশের জনগণ যারা নিজেদের মাতৃভূমিতে শান্তিতে এবং স্বাধীনভাবে বসবাস করতে চায়, তাদের স্বার্থে এই দ্বন্দ্বের একটামাত্র সমাধান হতে পারে। আর তা হল সরাসরি এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এখানে পুনরায় উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের জনগণ এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস এবং সুবিধাই ঐক্যের একমাত্র ভিত্তি হতে পারত, যেহেতু তাদের ভাষাগত, জাতিগত, সংস্কৃতিগত এবং ইতিহাসগত কোন মিলই নেই। সাধারণ ধর্মের যুক্তিটি দ্বিতীয় ইঙ্গিতেই খুব অর্থহীন এবং সেকেলে।

ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং তেমন অন্যান্য কিছু দেশ যারা পাকিস্তানকে বিপুল পরিমাণে সাহায্য দিয়েছিল, ঋণদাতা হিসেবে তারা ব্যাপক শঙ্কিত ছিল। যদি পাট এবং চা উৎপাদনে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়, পাকিস্তান কি ঋণ পরিশোধ করতে পারবে? এটাই ছিল তাদের প্রধান শংকা এবং ইয়াহিয়ার অপরাধের ব্যাপারে দ্বিধান্বিত নীরবতার কারণ। যখনই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে, পশ্চিম পাকিস্তান তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়। সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠার আর কোন ভিত্তি নেই- এরুপ নিছক দাম্ভিকতার মধ্য দিয়েই ইয়াহিয়া এবং তার নির্বোধ উপদেষ্টারা বিষয়টি উপলব্ধি করে। ফলে, দায়িত্বভারটা এসে পড়ে ঋণদাতাদের কিছু অংশের উপর, যারা একইসঙ্গে ইসলামাবাদের রাজনৈতিক উপদেষ্টাও ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশ স্থায়ী এবং ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। যত দ্রুত তারা এটা উপলব্ধি করবে ততই মঙ্গল। নতুবা বাস্তব গ্রহণযোগ্যতায় তারা ঋণ এবং অন্যান্য পরিসেবায় আরো বেশি লোকসানের সম্মুখীন হতে পারে।

এখন একমাত্র যেটা করার রয়েছে তা হল ইয়াহিয়া এবং তার দলকে আলোকদর্শন করানো এবং ইতিহাসের রায় মানতে বাধ্য করা। হয়ত, বৃটেনের মত দেশ জাতিসংঘের চেয়ে এই কাজটির জন্য অধিক পারদর্শী ছিল, যেখানে ইতোমধ্যে অন্য কিছু দেশ সাড়ে সাতকোটি মানুষের জীবন-মৃত্যু বিষয়ক ফুটবল খেলার বিষয়ে অনুরক্তি দেখিয়েছে।

জাতিসংঘে খেলাটা ইয়াহিয়ার সাথে বেশ মানানসই ছিল। উপরন্তু, এই সহানুভূতিহীন নীরবতার দরূন জাতিসংঘ বস্তুত তার মধ্যস্থতা করবার ন্যায়সংগত অধিকারটুকুও হারিয়ে ফেলেছে।

Scroll to Top