৩২১. ২২ অক্টোবর বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ

অনুবাদঃ ইফতেখার আহমেদ

<৬,১২১,৫৫৫-৫৫৭>

শিরোনামঃ বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ

সংবাদপত্রঃ দি নেশন ভলিউম ১ নং ৩

তারিখঃ ২২ অক্টোবর, ১৯৭১

.

দুর্ভিক্ষ কবলিত বাংলাদেশ

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক কঠোর বাবস্থাপনায় ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের পরবর্তীতে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন আরও গভীরভাবে  দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছে। একটি আন্তর্জাতিক জরিপ অনুযায়ী, আগামী মাসগুলোতে ১০ লক্ষ মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করবে যদি না অতিসত্বর  তৎপরতার সাথে এবং বিস্তারিতভাবে আন্তর্জাতিকভাবে সংগঠিত ত্রাণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয়।

এই বছর পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সন্ত্রাসী রাজত্বে বাংলাদেশের চাষাবাদ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায়  ইতিমধ্যেই এইখানে একটি ঘাটতি   দেখা দিয়েছে। এর ফলস্বরূপ, চলতি মৌসুমে ধান চাষাবাদ অতিশয় লক্ষ্যভ্রষ্ট  হয়েছে। ফলে নভেম্বর মাসের ফসলের ঘাটতি  প্রায় ৭ কোটি মানুষের মুখের খাবার যোগাতে  ব্যর্থ হবে।  

প্রকৃত সত্য এই যে, রক্ত পিপাসু পশ্চিম পাকিস্তান বাহিনী খাদ্যগুদাম ধ্বংস করতে চায়। সেটি হয় সকারি গুদাম অথবা ব্যক্তি মালিকানাধীন অথবা কোন বসতবাড়ির সঞ্চিত খাদ্যদ্রব্য।

এই দুঃখজনক  বাস্তবতা আবির্ভাবের অনেক আগেই আন্তর্জাতিক খাদ্য বিশেষজ্ঞগণ এমন একটি সর্বনাশা পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরেছিলেন। এই ভাবে দিনের পর দিন যেতে থাকলে পূর্ববঙ্গে একটি মর্মঘাতী  দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে যদি না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখনি হস্তক্ষেপ না করে।  এটাই ছিল দক্ষিণ এশীয় বিশেষজ্ঞদের কঠোর হশিইয়ারি , যারা সেইসময়  কানাডার অক্সফাম এর উদ্যোগে টরেন্টোতে সাক্ষাত করেছিলেন।

১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ গড়ে ১০.৮ লক্ষ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করে যা প্রয়োজনীয় ১২ লক্ষ টন থেকে ১০ শতাংশ কম। বারংবার বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের এই ঘাটতি পূরণে বাধা  সৃষ্টি করে  । বাৎসরিক বন্যা নিয়ন্ত্রণ অথবা সেচ নেটওয়ার্ক স্থাপনে  খুবই সামান্য উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল ।

বেশিরভাগ বাংলদেশের মানুষ অনিশ্চিত বিপদজনক সীমারেখায় বসবাস করছে।  তাদের আশেপাশের সামান্যতম চ্যুতি ঘটলেই অনেকেই অস্তিত্ব শঙ্কটের মুখে পড়বে।

যখন গত নভেম্বেরের ঘূর্ণিঝড় হানা দেয়, ৫ লক্ষ মানুষ ভেসে যায় ।  কিন্তু যে ৫০ লক্ষ  মানুষ বেঁচে ছিল, তারা নিশ্চিত ছিলনা না যে এই অগ্নিপরীক্ষায় তারা বেঁচে থাকতে পারবে কিনা।  পরিবহণ ব্যবস্থা এতটাই সেকেলে যে আন্তর্জাতিক খাদ্য সাহায্য সহযোগিতা দ্রুততার সাথে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে ছুটে যেতে পারে না।  মনুষ্যসৃষ্ট ইয়াহিয়ার দুর্যোগ আবার আরেক বিষয়। এটা শুধু যোগাযোগ এবং পরিবহনে সীমাবদ্ধ না। এটা সম্পূর্ণ ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দেয় ।

এপ্রিল মাসে ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী বিস্তৃত গ্রামাঞ্চলের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদের পাশবিক কার্যকলাপ ছিলঃ জীবনযাত্রা সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে ফেলাঃ   অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে। সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে নিরাপত্তাহীনতা, সন্ত্রাস এবং ভয় কাজ করছিল।
সেনাবাহিনীর বিধ্বংসতা  থেকে রক্ষা প্রাপ্ত কৃষিক্ষেত্র গুলো অরক্ষিত হয়ে পড়েছিল।কৃষি ব্যবস্থাপনা  ৯০ লক্ষ উদ্বাস্তু  ও তাদের গৃহপালিত পশুদের নিয়ে  প্রস্থানের ফলে ধসে পড়েছিল । সেই সাথে ৩ কোটি ছিন্নমুল জনগণ দেশব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। বাংলাদেশ কৃষিক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সহযোগী হিসেবে যেখানে  পৃথিবীর গর্ব ( একই আয়তনের ক্ষেত্রে) , সেখানে কৃষিজ যন্ত্রপাতির বিনষ্ট হওয়ায় নিজেদের খুঁজে পায় পতনের শেষ প্রান্তে।

নভেম্বর ফসল উৎপাদন ও জুন হল ফসল রোপণের মাস। কিন্তু এই সময় চাষাবাদ অনিয়মত হয়ে পড়েছিল । এমনকি পাকিস্তান সরকারের প্রতিবেদনেও দেখা যায় যে উৎপাদন স্বাভাবিকের চেয়ে দশ শতাংশ কমে গেছে।

এই মাসে ৪ হাজার বর্গ মাইল বন্যা কবলিত হয়েছিল। এই এলাকায়  যেই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হোক না কেন,সেটির অর্ধেক সম্পূর্ণরূপে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

মার্চের শেষের দিকে পিএল ৪৮০ খাদ্যশস্য যা স্বাভাবিক খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল, সেগুলো  চট্টগ্রামে সেনা-নৌ কার্যক্রম এড়াতে সরিয়ে নেয়া হয়েছিলো। এমনকি স্বাভাবিক অবস্থাতেও চট্টগ্রাম বন্দরের ধারণক্ষমতা বেশ সীমিত। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর করাচী থেকে ক্রমাগত সেনা সরবরাহ শীর্ষ অগ্রাধিকার থাকায় বন্দরে খাদ্য হ্যান্ডলিং ক্ষমতা আরও হ্রাস পেয়েছে।

সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে রেল ও সড়ক যোগাযোগ অকেজো। উপকূলীয় অঞ্চলে খাদ্যাদি বহনের একমাত্র মাধ্যম নদী পথ । সকল জলযান, এমনকি অভাবগ্রস্তদের নিকট খাদ্য প্রেরণের জন্য  আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রদত্ত জলযানগুলোও ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর সেনাদল বাহক এবং গানবোটে রুপান্তরিত করা হয়েছিল।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মাথায় শুধুমাত্র একটি উদ্দেশ্য খুব সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত রয়েছেঃ
যে কোনো মূল্যে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে  রাখতে হবে।সেনাবাহিনী ওই একটি ভাষাই বোঝে  । যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ত্রানসামগ্রী বহনের জন্য জলযান তুলে দেয়া হয়েছিল, তখন একজন সেনা কর্মকর্তা মন্তব্য করেন:”এখন আমরা সেইসব এলাকায় যেতে পারবো যেখানে অতীতে পারিনি।” তিনি জানতেন কিভাবে এইগুলো ব্যবহার হবে ।
 
ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের ডঃ লিংকন সি.চেন এবং শিশু হাসপাতাল মেডিকেল সেন্টারের ডাঃ জন ই.রোহডে ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে একটি প্রবন্ধ ‘ল্যানসেট’এ পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে,এখন ও নভেম্বরের মাঝে আনুমানিক ২ কোটি ৫০ লক্ষ জনগণ এক নজিরবিহীন দুর্ভিক্ষে পতিত হবে। 

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশে ৩০ লক্ষ মানুষ অনাহার মৃত্যুবরণ করে। এই আসন্ন দুর্ভিক্ষ তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের মাত্রার চেয়ে অনেক দূর ছাড়িয়ে যাবে।একটি রক্ষণশীল ৩০ লক্ষ টন খাদ্য ঘাটতিতে (মোট চাহিদার এক চতুর্থাংশ) অনাহারে মৃত্যু সংখ্যা হতভম্ব করে ১ কোটি কিংবা তারও বেশি হতে পারে।
যদিও একটি বিশাল মানবিক বিপর্যয় দৃশ্যমান, ইয়াহিয়া  জাতিসংঘের সাথে খেলা খেলে যাচ্ছে । তিনি তার দখলদার সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধান ছাড়া কোন ত্রাণ কার্যক্রম অনুমতি দেননি।আর পূর্বের ত্রাণ কার্যক্রমের ধরন দেখে বাঙালিরা জানে যে,তারা সেনাবাহিনীর সাহায্য ছাড়াই নিরাপদ থাকবে। যদি বিশ্ববাসী এই লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনের জন্য কোনভাবে নিজেদের দায়ী মনে করে ,তাহলে তাদের কাছে পৌঁছানোর একমাত্র উপায় হল বাঙালি জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যম।
প্রাক্তন ব্রিটিশ শ্রম মন্ত্রী পিটার শরে অনুরুপ প্রস্তাব দেন।“ সর্বপ্রথম জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশ প্রতিনিধি মধ্যকার আস্তাভাজন সম্পর্ক দ্রুত স্থাপন করা জরুরি।”বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই এই পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং সঙ্গত কারনেই প্রশাসনিক খাদ্যত্রান কর্মসূচী বাতিল করতে হবে।”

বিশ্ব বিবেক বলে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে এটা ভয়ঙ্কররুপে অস্বস্তিদায়ক হবে যে আগামী মাসগুলোতে দশ লক্ষ মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করবে। খুব অল্প সময় বাকী আছে। বিবেকবান নারী এবং পুরুষদের  এখনই সক্রিয় হতে হবে।

Scroll to Top