১৪৯. ২৮ সেপ্টেম্বর সম্পাদকীয়ঃ ইতিহাস আমাদের অনুকূলে

দীপংকর ঘোষ দ্বীপ

<৬,১৪৯,২৪৩-২৪৪>

সংবাদপত্রঃ বাংলার বাণী মুজিব নগরঃ ৫ম সংখ্যা

তারিখঃ ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

ইতিহাস আমাদেরই অনুকূলে

       স্বাধীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে পরিচালিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছয় মাস অতিক্রম হইয়াছেন । গত ২৫শে সেপ্টেম্বর ছিল বীর প্রসবিনী বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার সুমহান সংগ্রামের অর্ধবর্ষ পূর্তির দিন । এই ছয় মাস বাঙ্গালী জাতি অতুলনীয় সাফল্যের সঙ্গে লড়াই করিয়াছে হানাদার পাঞ্জাবী উপনিবেশবাদী সমর শক্তির বিরুদ্ধে । এই ছয় মাসে দুর্ধর্ষ বাঙ্গালী জাতির কামান-বন্দুক-মেশিনগান দুশমনের মৃত্যুঘন্টা বাজাইয়া সঘন গর্জনে বিস্মিত বিশ্ববাসীকে জানাইয়া দিয়াছে চিরদিন কাহারও কলোনী হইয়া, বাজার হইয়া, গোলাম হইয়া থাকার জন্য বাঙ্গালীর জন্ম হয় নাই । দুর্বিনীত বাঙ্গালী জাতি ছয় মাসের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধে অকল্পনীয় সাফল্যের সগর্ব ঘোষণার সমগ্র পৃথিবীকে বুঝাইয়া দিয়াছে, জননী বাংলার স্বাধীনতার সোনালী স্বপ্নকে নস্যাৎ করিতে পারে এমন শক্তি পৃথিবীতে কাহারও নাই । টিকিয়া থাকার জন্যই স্বাধীন বাংলার জন্ম হইয়াছে ।

       বিগত ২৫শে মার্চ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হইলে জল্লাদ ইয়াহিয়া আর কসাই টিক্কা খান ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বাঙ্গালী জাতির এই অভ্যুত্থান, এই মুক্তিসংগ্রাম ধূলিসাৎ করিয়া দেওয়ার হাস্যকর খোয়াবে মাতিয়া উঠিয়াছিল । আর এজন্য হানাদার বাহিনী ‘ক্রাস বেঙ্গলী প্রোগ্রাম’ তৈরী করিয়া বাংলার দশদিগন্তে শহর নগর বন্দর জনপদে নিহত মানুষের উপর মারণাস্ত্র লইয়া ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছিল নররক্ত লোভী হিংস্র হায়েনার আদিম বর্বরতায় । মানব ইতিহাসের ঘৃণ্যতম জল্লাদ ইয়াহিয়ার লেলাইয়া দেওঘর ভাড়াটিয়া বাহিনীর সেই নজিরবিহীন নরমেধযজ্ঞ চলিয়াছে দিনের পর দিন । মুক্তিপাগল লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীর বুকের তাজা রক্তে বাংলার কাজল মাটি লালে লাল হইয়া গিয়াছে, অসংখ্য জনপদ বিধ্বস্ত হইয়াছে । অগণিত ঘর-বাড়ী সোনার সংসার পুড়িয়া ছাই হইয়াছে । চিরতরে নিভিয়া গিয়াছে অনেক ঘরের প্রদীপ । কিন্তু তবু বঙ্গবন্ধুর মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত দুর্ধর্ষ বাঙ্গালী জাতি এই প্রাগৈতিহাসিক বর্বরতার কাছে, এই হিংস্র শক্তি প্রয়োগের কাছে মাথা নত করে নাই । বলদর্পী জালেমের পদতলে বিকাইয়া দেয় নাই আত্মার অন্তরঙ্গতম বাসনাকে, স্বাধীনতার অমোঘ স্পৃহাকে । শুধু তাই নয়, অমিত বিক্রমশালী বাঙ্গালী জাতির প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণে ক্রমাগত নাস্তানাবুদ, পর্যুদস্ত হইতে হইতে হানাদার বাহিনীর এখন মরণদশা সমুপস্থিত । বাংলার অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের গোলার আঘাতে ইয়াহিয়া-টিক্কার ‘ক্রাস বেঙ্গলী প্রোগ্রাম’ নিশ্চিহ্ন হইয়া কোথায় মিলাইয়া গিয়াছে । টিক্কা নিজেই ক্রাশ হইয়াছে । ইয়াহিয়ার অবস্থাও না যায় প্রাণ কাকুতিসার কুপোকাৎ হওয়াটা শুধু সময়ের প্রশ্ন ।

       ছয় মাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বহুদুর আগাইয়া আসিয়াছে । মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ২৫ হাজার খান সেনা খতম হইয়াছে, অগণিত রাজাকার কচুকাটা হইয়াছে । হানাদার বাহিনীর বহু জাহাজ ধ্বংস হইয়াছে, পথ-ঘাট, রেল-সেতু বোমার আঘাতে উড়িয়া গিয়াছে । শক্তি হাতে কৃষ্ণদণ্ড ধরিয়া যুদ্ধবিক্ষত বাংলাদেশে ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ ফিরাইয়া আনার সদম্ভ জল্লাদী ঘোষণাও চূড়ান্তভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছে ।

       অবস্থা বেগতিক দেখিয়া পররাজ্যলোভী হানাদার জঙ্গীশাহী বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বিনষ্ট এবং মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করার উদ্দেশ্যে বগ্লাহীন অত্যাচার, অবিরাম মিথ্যা প্রচারণা, এমনকি বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসনের আয়োজন করিয়া তাঁহার জীবন লইয়া ছিনিমিনি খেলার ঘৃণ্য তৎপরতায় লিপ্ত হইয়াছে । কিন্তু কিছুতেই ফল হয় নাই । বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম আগাইয়া চলিয়াছে দ্রুত বেগে । প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা শত্রুমুক্ত হইতেছে । প্রতিদিন অধিকতর বিপর্যয় নামিয়া আসিতেছে হানাদার কসাই বাহিনীর ভাগ্যে । আজ প্রত্যাসন্ন পরাজয়ের মুখে দাঁড়াইয়া একদিনের দাম্ভিক জেনারেল ইয়াহিয়া তাহার নিজের ভাষায় ‘দেশদ্রোহী’ এবং ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার দায়ে অভিযুক্ত’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়া হইলেও পাকিস্তানকে টিকাইয়া রাখার উদ্দেশ্যে আপোষের আরজি লইয়া  দেশ-দেশান্তরের দুয়ারে দুয়ারে ধর্ণা দিয়া বেড়াইতেছে । সুনিশ্চিত পরাজয়ের বিভীষিকা তাকে এমনই বেসামাল-দিশেহারা করিয়া তুলিয়াছে যে, সে এই বাস্তব অবস্থাটাকেও উপলদ্ধি করিতে পারিতেছি না যে, পাকিস্তান আর কোন দিন এক হইবে না । বিনাশর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি, হানাদার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং জঙ্গী বর্বরতায় ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান না করা পর্যন্ত একটি মুহূর্তের জন্যও বাংলার আপোষহীন মুক্তিযোদ্ধাদের সমরাস্ত্রের ধ্বনি স্তব্ধ হইবে না ।

       বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যজনক অর্থ বর্ষপূর্তির এই শুভলগ্নে আমরা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানাই । তাদের বীরত্ব, তাদের বিক্রম, তাদের মহান সংগ্রামী চেতনা গর্বে আমাদের বুক ভরিয়া দেয় । আমাদের ইতিপূর্বেকার বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করিয়া আমরা নির্দ্বিধায় বলতে চাই, বাংলার মাটি ও মানুষকে ভালোবাসিয়া, স্বাধীন বাংলার রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসিয়া তাঁহারই নির্দেশে যারা শত্রুর সঙ্গে জীবনপণ যুদ্ধে লিপ্ত, যারা জীবনকে বাজি রাখিয়া বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা এবং জল্লাদের কারাগার হইতে শেখ সাহেবকে ছিনাইয়া আনার গৌরবময় সংগ্রামের নির্ভীক সেনানী, তাদের জানাই হাজার সালাম । তাদের হাতের রাইফেল, মেশিনগানের মধ্য দিয়াই হানাদার দুশমনের বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষায় কথা বলিয়া উঠিয়াছেন লক্ষ লক্ষ শেখ মুজিব । মুক্তিযোদ্ধারা তাই বাংলার অগ্নিসন্তান- বাংলার শৌর্য, বাংলার সম্ভ্রম, বাঙ্গালীর স্বাধীনতা স্পৃহার নির্ভুল প্রতীক- শেখ মুজিবের বিশ্বস্ততম প্রতিনিধি । আমরা আবার তাদের অভিবাদন জানাই বীর হিসাবে ।

       হানাদার দুশমনের বিরুদ্ধে সফল মুক্তিযুদ্ধের অর্ধ বর্ষপূর্তির এই শুভলগ্নে বাঙ্গালীর চিত্তে চিত্তে আজ নতুন করিয়া আবাহনী চলুক সেই শাশ্বত বিশ্বাস ও প্রত্যাশার, সংকল্প আর প্রতিজ্ঞারঃ

       হানাদার দস্যুবাহিনী আর তার মুরব্বিদের সমরাস্ত্রনিসৃত গোলাবারুদের ধুম্রজালের আড়াল হইতে বঙ্গবন্ধু আর স্বাধীনতার রক্তসূর্যটাকে বাঙ্গালী জাতি ছিনাইয়া আনিবেই । আমরা- সংগ্রামী গণশক্তির সূর্য সম্ভাবনায় বিশ্বাসী । তাই আমরা বিশ্বাস করি, স্বাধীন বাংলা শত্রুমুক্ত হইবেই- শেখ মুজিব ফিরিয়া আসিবেনই । কারণ, ইতিহাস আমাদের অনুকূলে ।

Scroll to Top