১২৯। ৭ নভেম্বর সম্পাদকীয়ঃ বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ কারী কে ? দুষ্কৃতিকারী কে ?

শাহজালাল

<৬,১২৯,২১৪-২১৫>

সংবাদপত্রঃ বিপ্লবী বাংলাদেশ ১ম বর্ষঃ ১২শ সংখ্যা

তারিখঃ ৭ নভেম্বর, ১৯৭১

সম্পাদকীয়

 

বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী কে?

দুস্কৃতকারী কে?

চল্লিশ বৎসর পূর্বে হিটলারের রাক্ষস চিৎকারে ইউরোপের আকাশে মুহুর্মুহু বিদীর্ণ হত। চিৎকার আর্তনাদের। তার বিলাপের বিষয়বস্তু ছিলঃ অন্যান্য দেশের আক্রমণাত্মক কার্যে জার্মানী ও জার্মান জাতি বিপন্ন।

অথচ বিশ্বের লোকের চোখে এর বিপরীতটাই সত্য বলে মনে হত। কারণ তারা দেখত যে জার্মানীই আজ অস্ট্রিয়াকে কাল চেকোস্লোভাকিয়াকে পদাতিক, ট্যাঙ্ক এবং বিমান বাহিনিযোগে আক্রমণ করছে। কারণ প্রকৃতই ঐ বিপরীতটাই সত্য।

আজ চল্লিশ বৎসর বাদে হিটলারের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইয়াহিয়াও রাক্ষস চিৎকারে পাক-ভারত-বাংলাদেশের আকাশ আচ্ছন্ন করছে। বুলি, পাকিস্তান বিপন্ন। ভারতের প্ররোচনায় ভারতের অনুচরবর্গ পাকিস্তানের পুণ্যভূমি আক্রমণ করেছে। তাদের দুষ্কৃত কার্যে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান ছিন্ন- বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বার উপক্রম হয়েছে। এই বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাবার একমাত্র উপায় ভারত আক্রমণ।

কিন্তু আজও বিশ্বের লোকের চোখে প্রতিপন্ন হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে যে ইয়াহিয়ার অভিযোগের বিপরীতটাই সত্য। বিশ্বের লোকের সমক্ষে বাংলাদেশের শতকরা ৯৯ জন লোক প্রকাশ্যে নির্বাচনে বাংলাদেশের স্বাতন্ত্রের দাবী ঘোষণা করেছে। তার কারণ বাংলাদেশের বুকের উপর বসে গত চব্বিশ বছর যাবৎ পশ্চিম পাকিস্তানের মুষ্টিমেয় ধনপতি এবং ভূস্বামী বাঙালীর রক্ত শোষণ করেছে।

বাংলাদেশের শতকরা ৯৯ জন লোক-যাদের বাংলার মাটিতে জন্ম, যারা বাংলার মাটিতে বসে পুষ্ট- তারা কি ‘অনুপ্রবেশকারী’? সেই শতকরা ৯৯জন বাঙালির আকাঙ্ক্ষা, শোষ্ণাবসানের কামনা যারা রক্ত দিয়ে পূর্ণ করতে যাচ্ছে, সেই বাঙালী মুক্তিযোদ্ধারাই কি ‘অনুপ্রবেশকারী’?

না কি, সেই সব পশ্চিম পাকিস্তানী ধনিক-ভূস্বামী-রক্তপিপাসু যুদ্ধলিপ্সু সেনাধ্যক্ষরাই অনুপ্রবেশকারী? অবশ্যই তারা অনুপ্রবেশকারী। প্রথমতঃ তারা পাকিস্তানের শাসনযন্ত্রে অনুপ্রবেশ করেছে। কোন নির্বাচনে কে সিকান্দার মির্জা-আইয়ুব-ইয়াহিয়া খানকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছে? কেউ নয়। পশ্চিম ধনীক ভূস্বামী বর্গ এবং তাদেরই বেরাদর সেনাধ্যক্ষরা পদাতিক, ট্যাঙ্ক এবং বিমানবাহিনীর শক্তির বলে পাকিস্তানের ভাগ্যনিয়ন্তা সেজে বসেছে।

হাজার মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তানী পদাতিক, ট্যাঙ্ক, বিমানবাহিনীর প্রয়োগ দ্বারা বাংলাদেশের শতকরা ৯৯ জনের রায় পদদলিত করে, তাদের প্রাণাধিক প্রিয় নেতা মুজিবকে বন্দী করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এবং তাদের দুষ্কৃতী চরমে উঠেছে বাংলার গ্রাম জ্বালিয়ে, লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে হত্যা করে, লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত করে, বাঙালী নারীকে ধর্ষণ ও লাঞ্ছনা করে, বহু বাঙালী বীর সন্তানকে নিরস্ত্র করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। দুষ্কৃতকারী পশ্চিম পাকিস্তানী পশুশক্তিই- আর কেউ নয়।

এবং এর হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার একমাত্র উপায় মুক্তিবাহিনীর অবিরাম, নিরবচ্ছিন্ন প্রতি- আক্রমণ। তার অবসান পূর্ণ স্বাধীনতায়।

Scroll to Top