১১৪। ১৭ সেপ্টেম্বর মুক্তি সংগ্রামের নতুন দিক

সৌ রভ

<৬,১১৪,১৮৭-১৮৮>

শিরোনাম ( মুক্তি সংগ্রামের নতুন দিক )

সংবাদপত্রঃ বাংলার মুখ ১ম বর্ষঃ ৬ষ্ঠ সংখ্যা

তারিখঃ ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

.

                                মুক্তি সংগ্রামের নতুন দিক

অধিকৃত বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী ইসলামবাহিনী বিতাড়নের জন্য মুক্তিবাহিনী যেমন তৎপর হয়ে উঠেছে,তেমনি তৎপর হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট কূটনীতিবিদরা। বিভিন্ন রাষ্ট্রে নিযুক্ত কূটনীতিবিদরা পাকিস্তানীদের সাথে সম্পর্কছেদ করে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের সংগ্রামের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন এবং একই সাথে তারা কূটনৈতিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন।

.

আধুনিক সশস্ত্র সংগ্রামের কূটনৈতিক চালের যে মূল্য নেই এ কথা বলা মুশকিল। বিশেষতঃ বিরোধী শক্তি যদি কোন বিশেষ রাষ্ট্রগোষ্ঠীর কূটনৈতিক আশ্রয়ে থাকে সেক্ষেত্রে সংগ্রামী পক্ষও গ্রহণ করতে হয় অনুরুপ কূটনৈতিক পদ্ধতি। সংগ্রামে প্রচারের ভূমিকার পাশেই কূটনৈতিক মারপ্যাঁচের স্থান নির্ধারিত করা যেতে পারে।

.

অনস্বীকার্য যে বিশ্বের প্রতিটি সংগ্রামী জনসাধারণ আত্মপক্ষ সমর্থন জন্য খুঁজেছে কোন না কোন কূটনৈতিক দিকে ক্ষমতাবান দেশকে। এর অন্যমত কারণ, যে দেশগুলোর স্বাধিকার অর্জনের জন্য সংগ্রাম শুরু করেছে এমন কতকগুলি শক্তির বিরুদ্ধে যে শক্তিগুলোর পেছনে ছিল উপনিবেশবাদী সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী ক্ষমতা। তাই তাদের সংগ্রামে প্রয়োজন হয়েছে অনুরুপ ক্ষমতাবান শক্তির সমর্থন।

.

আমাদের মুক্তি সংগ্রামের প্রথম দিকে আমরা শুধু শত্রুর মোকাবিলা করেছি অস্ত্রে, অন্যদিকে শত্রু শুধু অস্ত্রেই নয়, তার প্রচার মাধ্যমে ও কূটনৈতিক মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে প্রকৃত ঘটনা থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব এবং জোটবহির্ভূত তৃতীয় বিশ্ব নামে কথিত শান্তিকামী দেশগুলো শুধু অবাক বিস্ময়ে চেয়ে থেকেছে। কারণ বাংলাদেশের সামগ্রিক ঘটনা তাদের কাছে পৌঁছায়নি। যেটুকু পৌঁছেছিল তা হল জবরদখলকারীর বিকৃতি। আমরা যে গনতন্ত্রে বিশ্বাসী একটি জনগোষ্ঠী ছিলাম এবং আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে স্বৈরাচারী সরকার যে শোষণকে কায়েম রাখতে চেয়েছে এবং আমাদের ওপর সশস্ত্র সংগ্রাম চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এ কথা জানতে পারেনি বিশ্বের কেউই বরঞ্চ বিশ্ব জনমতের এই ভ্রান্তির সুযোগে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী আমাদের দেশটাকে ও সংগ্রামটাকে তাদের স্বার্থে স্ট্রাটেজিক প্রয়োজনে ব্যবহার করতে চেয়েছে। কূটনৈতিক চালে ফেলে আমাদের বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে।

.

কমনওয়েলথে বাংলাদেশের যোগদান করার কথা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি জনাব কে, এম, সাহাবুদ্দিন এবং এ জন্যেই জনাব হোসেন আলীকে ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনার হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। নয়াদিল্লীতে হাইকমিশনারের অফিসও স্থাপিত হচ্ছে।

.

আবার অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ আসন্ন অধিবেশন তাদের প্রতিনিধি পাঠাবার কথাও ঘোষণা করেছেন। সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের অন্যতম উদ্দেশ্য জাতিসংঘের সমর্থন অর্জন।

.

অন্যদিকে এও জানা গেছে যে আসন্ন সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভারত সরকার বাংলাদেশ প্রশ্ন উত্থাপন করবে। এ ব্যাপারে ভারত সরকার হয়ত সোভিয়েত রাশিয়ার সাহায্য অথবা অনুমোদনও নিতে পারে। রাজনৈতিক মহল এ নিয়ে বেশ সরগম হয়ে উঠেছে।

.

সম্প্রতি কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত সপ্তদশ কমনওয়েলথ শারদীয় অধিবেশনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর বর্বর অত্যাচারের তীব্র সমালোচনা করা হয় তাছাড়াও সিংহল, ফিলিপিন, নেপাল, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশে বাংলাদেশের মিশন স্থাপিত হতে যাচ্ছে।

.

সমগ্র পরিস্থিতি দৃষ্টে এটুকু আশা করা যায় যে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম তার সর্বাঙ্গিন রুপ পরিগ্রহ করেছে এবং তার আপন অধিকার শুধু দেশের মাঝেই সীমিত রাখবে না বিশ্বের মাঝেই সে তার স্থান করে নেবে। বিশ্বের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী শান্তিকামী মানুষের যেমন সমর্থন সে কামনা করছে তেমনি বিশ্বের শোষণ মুক্তির প্রতিটি সংগ্রাম সে করবে সমর্থন।

.

সংগ্রামের যথার্থ মুহূর্তেই সূচিত হয়েছে আমাদের এই কূটনৈতিক তৎপরতা। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা আজ হানাদারমুক্ত। বাংলাদেশ সরকার সেখানে তাদের কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ বজায় রেখে চালিয়ে যাচ্ছেন প্রশাসন ব্যবস্থা। ঠিক এই পরিস্তিতিতে তার স্বীকৃতির প্রয়োজনে কূটনৈতিক কার্যপদ্ধতি অত্যন্ত প্রয়োজন।

.

তবে এটা ঠিক যে আমাদের এই কূটনৈতিক তৎপরতায় চিনে নিতে হবে আমাদের হিতাকাঙ্ক্ষীদের। কারণ ইতিহাস আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে যে মিত্ররুপী শত্রু একটা দেশকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য কিনা করেছে। কূটনৈতিক ফাঁদে পড়ে বাংলাদেশ সমস্যার যে অপঘাত হতে যাচ্ছিল ওই তৎপরতায় প্রমানিত হল যে বাংলাদেশের সংগ্রাম একমুখী নয়। শত্রুর প্রতিটি আস্তানায় হানা দেবে বাঙ্গালার বীর সন্তানরা এবং তারা হবে জয়ী।

.

শুধু দু’চারটি  দেশে নয় এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার যে দেশগুলো আমাদের সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল সে সব দেশেও আমাদের মিশন স্থাপন করতে হবে এবং কূটনৈতিক বোঝাপড়ার মাধ্যমেই গড়ে তুলতে হবে আমাদের পররাষ্ট্র নীতি।

.

বেসামাল জঙ্গীশাহী আপ্রান চেষ্টা করেছে বাংলাদেশে দালালশাহী প্রবর্তনের। প্রতিক্রিয়াশীল ও ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলোকে এক করে চেষ্টা করেছে দালাল গনতন্ত্র সৃষ্টির। এর পেছনে যুক্তি একটি সেটা হল বিশ্ব জনমতকে বিভ্রান্ত করা। অতএব আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ হবে সংগ্রামী পদক্ষেপ। আমাদের ধরে নিতে হবে যে আমরা প্রতিটি পদক্ষেপ সংগ্রামের সম্মুখীন হচ্ছি এবং যে সংগ্রাম আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। শত্রুর প্রতিটি গতিবিধি লক্ষ্য রেখে পরিচালিত করতে হবে আমাদের সংগ্রাম কৌশল।

Scroll to Top