স্বাধীনতা এলো, দানবীর আর পি সাহা আজও এলেন না

২৯। স্বাধীনতা এলো, দানবীর আর পি সাহা আজও এলেন না (৪০৫-৪০৬)

সূত্র -দৈনিক আজাদ, ৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭২।

গাড়ীর শব্দ শুনলেই মনে অয় – “এই বাবু আইতাছে”
স্বাধীনতা এলো, দানবীর আর পি সাহা আজও এলেন না

জেঠামণি না আসলে আমার কান্না পাবে, আমি এখানে থাকতে পারব না।’ কথা কটি বললো ভারতেশ্বরী হোমসের কিন্ডার গার্টেন দ্বিতীয় মানের ছাত্র রোকেয়া ইসলাম। বলতে বলতে কেঁদে ফেললো ৮ বৎসরের মেয়ে রোকেয়া। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বাঁধ ভাংগা বন্যার মতো তার অশ্রু ঝরছে। এ দৃশ্য বড় বেদনাদায়ক। এ দৃশ্য বড় মর্মান্তিক। অথচ কিছুক্ষণ পূর্বেও রোকেয়া তার সহগামী বোনদের সাথে মাঠে ছুটাছুটি করছিল।

ভারতেশ্বরী হোমসের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা হোমসের ছাত্রীদের সবার প্রিয় জেঠামণি। ৭১-এর মে মাসে পাক বাহিনী হোমসের ছাত্রীদের প্রিয় জেঠামণি আর তার ছেলে ভবানী আর তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাকে ধরে নিয়ে যায়।

অভিযোগ ওরা হিন্দু। ভারতের চর। আওয়ামী লীগের সমর্থক। কিন্তু হোমসের ছাত্রীরা উচ্চকণ্ঠে বলেছে “সব মিথ্যে সব মিথ্যে”। তিনি আমাদের আদর করেন। কান্না পেলে চোখের জল মুছিয়ে দেন। সত্যিই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা একটি মহিরুহ। এ মহিরুহের ছায়াতলে বিগত ৩০ বৎসর যাবত অসংখ্য ছাত্রী জ্ঞানের আলোকে উদ্দীপ্ত হয়েছে। আর পি সাহা হোমসের ছাত্রীদের ভালবাসতেন গভীরভাবে।

তাদের শাসনও করতেন কঠোরভাবে। আবার পরক্ষণেই মাথায় হাত বুলোতেন সস্নেহে। সকল দুঃখ, সকল বেদনা আসুখ বিসুখ ভুলে যেতেন এখানে এসেই। হোমসের ছোট ছোট মেয়েরাই ছিল তার কর্মজীবনের সঞ্জীবনী শক্তি, তার কর্মবহুল জীবনের প্রেরণা। আর এদের দিকে তাকিয়েই তিনি কাজ করতেন দিনরাত অনবরত। এদের মুখে হাসি দেখলে তিনি খুশি হতেন, পুলকিত হতেন। কুসুমের মতই ছিল তার মন কোমল আর বজ্রের মতই ছিল কঠোর তার বাহিরের রূপ।

হোমসের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা স্বাধীনতার পর আজ অবধি নিখোঁজ। তবে এ অন্তর্ধান সম্পর্কে কোন সঠিক তথ্যই উদঘাটিত হয়নি। হোমসের ছাত্রী শিক্ষয়িত্রী কুমুদিনি হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, রোগী, কুমুদিনি জনকল্যাণ ট্রাস্টের কর্মচারীসহ তার বন্ধুবান্ধব, শুভানুধ্যায়ী সবিশেষ উদ্বিগ্ন।

জেঠামণি ফিরে আসবেন। বাবু ফিরে আসবেন। আমাদের বিশ্বাস তিনি আজও বেঁচে আছেন। এ মহামানবের মৃত্যু হতে পারে না। তিনি তো মানবতাবাদী, সমাজবাদী। তার কোন শত্রু থাকতে পারে না। এ দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে সবাই অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছে। এ প্রতীক্ষা তাদের যেন আর শেষ হতে চাচ্ছে না। গভীর উৎকণ্ঠা আর প্রতিক্ষায় তাদের দিন কাটছে। হোমসের প্রিন্সিপাল মিসেস প্রভা মুৎসুদ্দি বললেন, আপনারা চেষ্টা করে দেখুন, কোন না কোন ভাবে কাকা বাবুকে ফিরিয়ে আনা যায় কিনা।

বিক্ষিপ্তভাবে সকলেই কাতর কণ্ঠে হরেক রকম মন্তব্য করছেন। হোমসের ভাইস প্রিন্সিপাল মিস সালমা রহমান বললেন এখান থেকে বিগত দিনগুলোতে শত শত ছাত্রী জ্ঞানের আলোক নিয়ে মানবতার মশাল নিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম বাংলার প্রান্তরে প্রান্তরে। আর তা শুধু সম্ভব হয়েছে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার মহৎ অনুভূতির ফলেই। এখানে ধনী, গরীব, হিন্দু, মুসলমানের কোন পার্থক্য নেই। আমরা সবাই একই পরিবারের সদস্য। জাতি ধর্ম বর্ণের এখানে কোন বাছ বিচার নেই। হোমসের দারোয়ান ইউনুছ মিয়া আর ইমান আলী মিয়া আমাদের দেখেই প্রশ্ন করলো “আপনারা কি বাবুর কোন খবর নিয়া আইছেন?” জিজ্ঞাসা করলাম “কোন বাবু?” “আমাগো বড় বাবু”।

তারপর অনেক আলাপ আলোচনার পর তারা বললো, “আমাগো মনে অইতেছে যেন অহনো বাবু আছে। গাড়ীর শব্দ শুনলেই মনে অয় যে, এই বুঝি বাবু আইতাছে।” সত্যিই কত গভীর অনুভূতি, সবাই এ অভাব অনুভব করছে। মনে মনে প্রাণে প্রাণে সবাই আজ এই অনুভবের অনুসারী।

Scroll to Top