সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার মেজর লুৎফর রহমান

<১০, ৪.৯, ১৮৪-১৯০>

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার মেজর লুৎফর রহমান

 

৩রা জুন: বজরার কুখ্যাত দালাল পাক সামরিক বাহিনীর অন্যতম সাহায্যকারী, নিরীহ গ্রামবাসীর ধনসম্পদ লুণ্ঠনকারী দানব সেরাজুল ইসলাম (ছেরু মিয়া-বজরা) এর অত্যাচারে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে তারই প্রভাবে এতদঞ্চলে বহু নিরীহ জনগণ রাজাকারে পরিণত হয়। তাই মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশারফ সাহেবের নির্দেশক্রমে ৩রা জুন রাতে বজরা স্কুলের পূর্ব দিকে তার গোপন আড্ডাখানায় অতর্কিত আক্রমণ করি।

কিন্তু সুচতুর দালাল ছেরু মিয়া টের পেয়ে পূর্বেই আত্মগোপন করে। তার ৪ জন সহকারী আমাদের হাতে ধরা পড়লে তাদেরকে হত্যা করা হয়। এদের মৃত্যুর পর এতদঞ্চলে আর তেমন কোন অত্যাচার হয়নি এবং ছেরু মিয়ারও তেমন কোন সন্ধান করতে পারিনি। অবশ্য দেশ মুক্ত হবার পর এই কুখ্যাত দালাল মীরজাফর মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং প্রকাশ্যে জনসাধারণের রায়ে তাকে হত্যা করা হয়।

৬ই জুন: বহু নিরীহ গরীব লোককে প্রলোভন দিয়ে মাইজদীতে রাজাকারে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হতো। সিপাই শাহজাহানকে পাঠালাম মাইজদীতে রাজাকার ট্রেনিং ক্যাম্পে হাতবোমা নিক্ষেপ করার জন্য।

শাহজাহান অতি গোপনে ও কৌশলে রাজাকার ট্রেনিং ক্যাম্পে ঢুকে হাত বোমা নিক্ষেপ করে। এতে রাজাকার কমান্ডার ও আরও দুইজন নিহত হয়। সিপাই শাহজাহান তাদেরকে হত্যা করে অসীম সাহসের পরিচয় দিয়ে বীরত্বের সাথে ফিরে আসতে সক্ষম হয়।

১১ই জুন: চন্দ্রগঞ্জ রাস্তায় পাকবাহিনীর চলাফেরা অনেকাংশে বেড়ে যাওয়ায় চন্দ্রগঞ্জের পুলটি উড়িয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেই। পুলের উভয় পাশে পাক বাহিনীর মেশিনগান মোতায়েন থাকা সত্ত্বেও পুলটি উড়িয়ে দিতে সক্ষম হই।

ইতিমধ্যে খবর পেলাম যে, আমাকে ধরার জন্য নোয়াখালীর পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ মোটা টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছে। গোপালপুর চৌধুরী বাড়ীর নসা মিয়া যদিও পাকবাহিনীর সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে যোগাযোগ রক্ষা করতেন কিন্তু মূলত তিনি আমাদেরকে গোপনে গোপনে পাক হানাদার বাহিনীর সমস্ত গোপনীয় তথ্য জানাতেন। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর স্বার্থেই তিনি পাঞ্জাবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আমাদেরকে সাহায্য করতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার চতুরতা ধরে ফেলে পাক হানাদাররা। তারা গোপালপুর আক্রমণ করে তাকে জঘন্যভাবে হত্যা করে।

এই নসা মিয়ার নিকটই আমি জানতে পারি যে আমাকে ধরার জন্য পাক বাহিনী মোটা টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে এবং অল্পদিনের মধ্যে তারা আমাদের মারাত্মকভাবে আক্রমণ করবে। আমি নসা মিয়ার নিকট এ খবর পাওয়ার পর আমিশাপাড়া ক্যাম্প তুলে নেই এবং অন্যান্য ক্যাম্প থেকেও সমস্ত সৈন্য তুলে নিয়ে সেনবাগের প্রতাপপুর নামক গ্রামে আত্মগোপন করি। অবশেষে ১৮ই জুন পাকসেনারা ১ ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে আমাকে ও আমার দলবলকে ধরার জন্য আমিশপাড়া-বজরা সড়ক, সোনাইমুড়ি-চাটখিল রোড, চট্টগ্রাম-খিলপাড়া সড়ক দিয়ে একই সময় অগ্রসর হন। অবশেষে তারা আমাদের পাত্তা না পেয়ে চলে যায়।

২১শে জুন: হাবিলদার মতিন অতর্কিতে দালালবাজার রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে একজন মিলিশিয়াসহ ১৬ জন রাজাকারকে হত্যা করে তাদের ক্যাম্প তছনছ করে দেয়।

২৩শে জুন: আপানিয়া পুলের নিকট কয়েকজন দালালসহ দু’জন পাকসেনা ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে থাকে। সম্ভবত সতী মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করার উদ্দেশ্যে ঘোরাফেরা করছিল; ঠিক সেই মুহূর্তে নায়েক সুবেদার শামসুল ও হাবিলদার মন্তাজ সেখানে উপস্থিত হয়ে পাকসেনা দু’জনকে খতম করে। অবশ্য দালালরা পালিয়ে যায়। এখানে শামসুল হক ও মন্তাজ অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিলে স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের মনোবল অত্যন্ত দৃঢ় হয়।

২৪শে জুন (বগাদিয়ায় পুনরায় বিস্ফোরণ ও যুদ্ধ): নায়েক শহীদ বগাদিয়ার নিকটে রাস্তার উপর মাইন বসিয়ে কিছুদূরে সরে থাকে। কিছুক্ষণ পর পাকবাহিনী এক প্লাটুন সৈন্য একটা ট্রাকে চলতে থাকলে মাইন বিস্ফোরণে গাড়িখানা সামান্য নষ্ট হয়। পরে মুহূর্তে কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে কোন ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি।

২৫শে জুন: রাতে হাবিলদার মতিন লক্ষ্মীপুর বাগবাড়ি ক্যাম্পে মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ করেও কয়েকজনকে আহত করে।

২৬শে জুন: সুবেদার ওয়ালী ওয়ালীউল্লা কাফলাতলী রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে কয়েকজন রাজাকারকে হত্যা করে ক্যাম্পটি তছনছ করে দেয়। ইতিমধ্যে শত্রুর কয়েকজন গুপ্তচর হাতেনাতে ধরা পড়ে। অপরদিকে সুবেদার শামসুল হকের হাতে একজন রাজাকার কমান্ডার ধরা পড়ে।

২৭শে জুন: আমি ভারত হতে পুনরায় বিস্ফোরণ ও গোলাগুলি নিয়ে আসি।

৩০শে জুন: হাবিলদার মতিনের নেতৃত্বে এবক প্লাটুন মুক্তিসেনা লক্ষ্মীপুর থেকে কালীরবাজার অগ্রগামী খানসেনাদের প্রচণ্ড আক্রমণ করলে কয়েকজন হতাহত হয়। পাকসেনা কালীরবাজারে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়।

১৭ই জুলাই: রামগঞ্জের উত্তরে নরিমপুর হতে এক কোম্পানী পাক রেঞ্জার্স ও রাজাকার দল অগ্রসর হতে থাকলে হাবিলদার জাকির হোসেনের নেতৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তি সেনা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর শত্রুরা রাজাকারের দুটি মৃত দেহ ফেলে দৌড়ে প্রাণ বাঁচায়। পরে হাবিলদার জাকির হোসেন মৃত রাজাকারদ্বয়ের দাফনের ব্যবস্থা করে।

 

১৯শে জুলাই: কয়েকজন রাজাকার হানাদার বাহিনীর এক কোম্পানি সৈন্য মান্দারই বাজারে ক্যাম্প করেছিল। আমি উক্ত ক্যাম্প আক্রমণের জন্য সুবেদার ওয়ালিউল্লাকে আদেশ করি। ওয়ালিউল্লা, আহবিলদার মতিন ও শাহাবুদ্দিন মান্দারিতে শত্রু ঘাঁটির উপর আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর দুজন জোয়ান শহিদ হন।

২৩ শে জুলাই (পুনরায় সাহেবজাদা পুল চূর্ণবিচূর্ণ ): পাকবাহিনী সাহেবজাদা পুল মেরামত করে পুনরায় নোয়াখালীর সাথে এর রেল যোগাযোগ স্থাপন করে। আমি নায়েক আবুল হোসেন ও সুবেদার শামসুল হককে নিয়ে পুলটি নষ্ট করতে যাই। সেখানে কিছু রাজাকার ও মিলিশিয়া পাহারারত ছিল। তাদেরকে আমাদের দিকে আকৃষ্ট করার জন্য গোলাগুলি আরম্ভ করি। অপরদিকে নায়েক আবুল হোসেন পুলের নীচে গিয়ে বিস্ফোরণ দ্রব্য লাগিয়ে সড়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পরই বিরাট আওয়াজে পুলটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং নোয়াখালীর সাথে রেল যোগাযোগ পুনরায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

২৬ শে জুলাই: এদিন সুবেদার ওয়ালীউল্লাকে নরিমপুর পাঠাই রেকি করার জন্য। ওয়ালীউল্লা নরিমপুর পৌঁছলে কয়েকজন পাক দালাল (অস্ত্রহীন) সুবেদার ওয়ালীউল্লাকে অতি কৌশলে ঘিরে ফেলে ও বন্দী করে। তৎক্ষণাৎ সুবেদার ওয়ালীউল্লা পিস্তল দিয়ে একজন দালালকে গুলি করে জীবনরক্ষার্থে প্রাণপণে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত পালাতে সক্ষম হয়।

১৪ আগস্ট (বসুরহাট যুদ্ধ): নোয়াখালী জেলার পশ্চিমাংশ থেকে পূর্বাংশে পাকবাহিনীর সৈন্যদের আনাগোনা বেশী পরিলক্ষিত হয়। এসময় চারদিক থেকে মুক্তিসংগ্রাম অধিকতর শক্তিশালী হতে থাকে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল অনেকগুণ বেড়ে যায়।

আমি বাছাই করা যোদ্ধাদের এক প্লাটুন মুক্তিসেনাকে নায়েক সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে পাঠাই বাবুরহাটে খান সেনাদের নির্মূল করার জন্য। অদম্য সাহসী বীরযোদ্ধা শামসুল হক এখানে খান সেনাদের উপর চরম আক্রমণ করে শত্রুর জীপ নষ্ট করে দেয় এবং কয়েকজনকে হত্যা করে। এ যুদ্ধে আমার দু’জন বীরযোদ্ধা শহীদ হন এবং দু’জন গুরুতরভাবে আহত হয়। সিপাহী নূরনবীর বৃদ্ধাঙ্গুল গুলির আঘাতে উড়ে যায়।

১৬ই আগস্ট (পুনরায় আপানিয়া পুল ধ্বংস): পাকবাহিনীর দ্বারা নতুন মেরামত করা আপানিয়া পুলটি নায়েক শহীদ ধ্বংস করে দেয় ও লাকসাম- নোয়াখালী যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

২৬ শে আগস্ট: মিলিশিয়া ও রাজাকার বাহিনীর একটি বিরাট দল আমিনবাজার থেকে আমিশাবাজার দিকে অগ্রসর হচ্ছে এ খবর পাবার পর আমরা তাদের চতুর্দিক দিয়ে ঘেরাও করার পরিকল্পনা করি। সুবেদার ওয়ালীউল্লাকে ত্রিমুখী আক্রমণ করার নির্দেশ দিলাম। নির্দেশক্রমে সুবেদার ওয়ালীউল্লাহ ত্রিমুখী আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। আমি নিজে এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে পিছন দিক থেকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। শত্রুরা আমিনবাজারের দিকে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে সুবেদার ওয়ালীউল্লা ত্রিমুখী শুরু করে। ফলে শত্রুরা পিছনে হটতে থাকলে আমি পিছন থেকে আক্রমণ করি। আক্রমণ চারিদিকে থেকে চলতে থাকে। কাজেই শত্রুরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। এদিকে জনসাধারণও ছত্রভঙ্গ হয়ে চারিদিকে দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। ফলে আমাদের পক্ষে গুলি করা বিরাট প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এ যসুযোগে শত্রুরা হাতের অস্ত্র ফেলে জনসাধারণের মধ্যে মিশে যায় এবং অনেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ছয়জন রাজাকার নিহত হয় ও কয়েকজন আহত হয়। আমরা উক্ত ছয়জন রাজাকারের লাশ কাচিহাটিতে দাফন করি। রাজাকার মাওলানা মিজানুর রহমান অক্ষত অবস্থায় অস্ত্রসহ আমাদের হাতে ধরা পড়ে। তার নিকট থেকে পাক বাহিনীর অনেক গোপন তথ্য সংগ্রহ করি। পরে তাকে হত্যা করে তারও দাফনের ব্যবস্থা করি। এখানে কয়েকটি চীনা রাইফেলও আমাদের হস্তগত হয়।

১০ই সেপ্টম্বর: রাজাকার ও পাকবাহিনী গোপালপুর সড়কে মুক্তিবাহিনীর গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য এবং সময়মত খবর দেবার জন্য ছোট একটি ছেলেকে নিয়োজিত করে। ছেলেটিকে তারা কিছু টাকা পয়সাও দিয়েছিল। কিন্তু গোপালপুর সড়কে সন্দেহভাজনভাবে ঘোরাফেরা করতে থাকলে গোপালপুরের ডা: আনিস তাকে ধরে ফেলে এবং তাকে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কাজ করানোর বাধ্য করে।

ইতিমধ্যে আমি বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে চলে যাই সমরাস্ত্র সংগ্রহ করতে। জনাব মেজর (বর্তমানে কর্নেল) খালেদ মোশাররফ আমাকে এ্যামুনিশন ও বিস্ফোরণ দ্রব্য সরবরাহ করেন এবং বিভিন্ন সময়ে গেরিলা পদ্ধতিতে মুক্তিযোদ্ধের রণকৌশল সম্বন্ধে অবহিত করেন।

আগস্ট- সেপ্টম্বর মাসে নোয়াখালী জেলায় রাজাকার আর আলবদরের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। সেজন্য নোয়াখালীর পরিষদ সদস্যগণ আমাকে পরামর্শ দিলেন কয়েক ভাগে ভাগ করে অন্যান্যদের হাতেও দায়িত্ব অর্পণ করে মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করার জন্য। আমি নতুন সমরাস্ত্র নিয়ে ভারত থেকে দেশে ফিরলাম। বহু ছাত্র-শ্রমিক ট্রেনিং শেষে দেশে ফেরে। আমি সদর মহকুমাকে চার ভাগে ভাগ করি-

(ক) দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের দায়িত্ব নিলাম আমি নিজে।

(খ) পূর্ব-দক্ষিণের দায়িত্ব দিলাম ওয়ালীউল্লাকে।

(গ) পূর্ব-উত্তরের দায়িত্ব দিলাম নায়েক সুবেদার শামসুল হককে।

(ঘ) পশ্চিম-উত্তরের দায়িত্ব দিলাম নায়েক সুবেদার ইসহাককে।

২রা ওক্টোবর: ছাত্র কমান্ডার একরাম- এর নেতৃত্বাধীন একটি গ্রুপ রামগঞ্জে রাজাকারদের আক্রমণ করে, অপরদিকে সুবেদার ইসহাক পানিয়ালা বাজার আক্রমণ করে ৪জন রাজাকার খতম করে। ৩ রা অক্টোবরে কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডার আবুল বাশার বিপুল শহর থেকে বগাদিয়া যাবার সময় সুবেদার শামসুল হকের হাতে বন্দী হয়। সুবেদার শামসুল হক তার কাছ থেকে পাকবাহিনীর গোপন তথ্য সংগ্রহ করে তাকে মেরে ফেলে।

১৮ই ওক্টোবর: নায়েক সুবেদার ইসহাক শামসুন্নাহার হাই স্কুলে অবস্থানরত রাজাকার ক্যাম্পে অতর্কিত আক্রমণ করে কয়েকজন রাজাকারকে হতাহত করে ও ৫টি রাইফেল উদ্দার করে। অপরদিকে নায়েক সুবেদার ওয়ালীউল্লা দালাল বাজার রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করতে গেলে দেখতে পায় যে রাজাকারকে লুণ্ঠিত কাপড় বন্টনে ব্যস্ত। সেই অবস্থাতেই তিনি তাদেরকে চরম আঘাত হেনে কয়েকজনকে হতাহত করেন। অবশিষ্ট রাজকাররা পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। পরে লুণ্ঠিত কাপড় মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এখানেও ৫টি রাইফেল উদ্ধার করা হয়।

মীরগঞ্জে রাজাকারের আত্মসমর্পণ: মীরগঞ্জে রাজাকাররা আত্মসমর্পণের জন্য আমার নিকট দু’খানা পত্র পাঠায়। প্রথম পত্র আমি মোটেই বিশ্বাস করতে পারিনি। দ্বিতীয় পত্রখানা পাবার পর এ্যাডভোকেট আখতারুজ্জামান সাহেবকে পাঠালাম আত্মসমর্পণের শর্ত নির্ধারণ ও মধ্যস্থতা করার জন্য। সুবেদার ওয়ালীউল্লাকে পাঠালাম সতর্কতার সহিত আত্মসমর্পণ করানোর জন্য। পূর্বশর্ত অনুযায়ী রাজাকাররা লাইন ধরে অস্ত্ররেখে দু’হাত উপরে তুলে নায়েক ওয়ালীউল্লার নিকট আত্মসমর্পণ করে। সংখ্যায় ছিল মোট ৩৭ জন রাজাকার ও ২৭ জন পুলিশ। কয়েকদিন তাদের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করার পর ৫/৭ জনকে ভাগ ভাগ করে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন প্লাটুনে দেয়া হয়। এদের মধ্যে দু’জন পুলিশ পুনরায় বিশ্বাসঘাতকতা করে। অবশ্য তারা পুনরায় মাইজদিতে ধরা পড়লে সেখানেই গুলি করে দেয় নায়েক সুবেদার ওয়ালীউল্লা।

২৩ শে অক্টোবর (প্রধান দালাল ননী চেয়ারম্যান ধৃত): লক্ষ্মীপুরের প্রধান দালাল ননী চেয়ারম্যানের অত্যাচারে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। লুটতরাজ, নারী ধর্ষণ, গণহত্যা, বাড়ি পোড়ানো, হানাদার বাহিনীকে মুক্তিবাহিনীর সন্ধান দেয়াই ছিল তার পেশা। অবশেষে বীর সাহসী যোদ্ধা নায়েক সুবেদার ওয়ালীউল্লা জালালের প্লাটুন নিয়ে এই কুখ্যাত দালাল বাহিনীর উপর আক্রমণ করে জীবিত অবস্থায় বাঙ্গালীর বিশ্বাসঘাতক দালাল ননী চেয়ারম্যানকে বন্দী করে। তার বন্দী হবার খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে কয়েক হাজার মানুষ সেখানে উপস্থিত হয়। সমস্ত মানুষের উপস্থিতিতে তার নিজ বন্দুক দিয়ে তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। ক্রুদ্ধ জনতা তার লাশ নিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মনের রাগ মিটায়।

২৯ শে অক্টোবর (সোনাইমুড়ি-চাটখীর যুদ্ধ): পাক বাহিনীর বেলুচ রেজিমেন্ট লাকসান থেকে কামান ও রকেটের সাহায্যে ফায়ার করতে করতে সোনাইমুড়ি থেকে চাটখীল সড়কের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এমন সময় ছাত্রদলসহ আমরা বাধা দিলে তুমুল লড়াই শুরু হয়। প্রায় ২/৩ ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। শত্রুপক্ষের কয়েকজন হতাহত হয়। শত্রুরা শেলিং করে হতাহত সৈন্যদের পার করে। হানাদার বাহিনীর শেলিং-এ একই বাড়ির ৫ জন নিরীহ লোক মারা যায়।

১০ই নভেম্বর: চন্দ্রগঞ্জের নিকটবর্তী রাস্তায় মাইন বসানো হয়। পাকবাহিনীর এক ট্রাক আটা লক্ষ্মীপুরে যাবার সময় ট্রাকটি মাইনের আঘাতে নষ্ট হয় এবং ড্রাইভার নিহত হয়।

১৩ই নভেম্বর: আমার নিজ প্লাটুন নিয়ে লক্ষ্মীপুর রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করি। এ আকস্মিক আক্রমণে বহু রাজাকার হতাহত হয়। এখানে জনসাধারণ বিশেষভাবে আমাদেরকে সাহায্য করেন।

১৭ই নভেম্বর: সুবেদার ওয়ালীউল্লা মধ্যরাতে রামগঞ্জে অতর্কিত আক্রমণ করে রামগঞ্জের রাজাকার ক্যাম্প নিশ্চিহ্ন করে দেন।

২৯ শে নভেম্বর: পশুবাহিনী একখানা ভ্যানে দু’জন স্ত্রীলোককে নিয়ে যাবার সময় বগাদিয়ার নিকট হাবিলদার আউয়াল গাড়িটি আক্রমণ করে। এ সময় পিছনের দিকে শত্রু বাহিনীর আরও কিছু সৈন্য সেখানে উপস্থিত হয়। আমিও আমার প্লাটুন নিয়ে আক্রমণ করি। ২/৩ ঘণ্টা যুদ্ধের পর তারা স্ত্রীলোক দু’জনকে রেখেই পলায়ন করে। পরে উক্ত স্ত্রীলোকদ্বয়কে তাদের আত্মীয়ের নিকট পৌঁছিয়ে দেওয়া হয়।

৩০ নভেম্বর: সাহেবজাদা পুল মেরামত করার সময় পাকবাহিনীর লোকজন হাবিলদার নূর মোহাম্মদ -এর হাতে মার খেয়ে পুল মেরামত বাদ দিয়ে পালিয়ে যায়।

১লা ডিসেম্বর: চন্দ্রগঞ্জ বাজারের সামান্য উত্তরে হাবিলদার রুহুল, আমি ও ছাত্র কমান্ডার সফি আলোচনা করি। এমন সময় আহত ছোট একটি ছেলে খবর দিলো যে পাঞ্চাবী সৈন্যরা চন্দ্রগঞ্জে আসছে। হাবিলদার রুহুল আমিনকে প্রস্তুতি নিতে বললাম। ইতিমধ্যে পাক-সৈন্য পৌঁছে গেছে। হাবিলদার রুহুল আমিন শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এ সময় আমার হাতে কোন অস্ত্র ছিল না। শুধু আমার বাহিনীকে কমান্ড করতে লাগলাম। শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ। ছাত্রদলের একমাত্র কমান্ডার সফি ও অন্যান্য কয়েকজন ব্যতীত সবাই সড়ে পড়লো। এ সময় আমি, ছাত্রদলের সফি এবং আওয়ামীলীগের বিশিষ্ট কর্মী আব্দুর রব চন্দ্রগঞ্জ বাজারের উত্তর-পূর্ব দিকে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের পরিস্থিতি দেখছিলাম। হঠাৎ শত্রুবাহিনীর কয়েকজন সৈন্য আমাদের কাছাকাছি এসে পড়ে। আমরা পিছনে সড়ি। তখন এল-এম-জি টার্গেট আমাদের দিকে। ছাত্রনেতা সফির হাত থেকে এল-এম-জি টা নিয়ে আমি তৎক্ষণাৎ একটা ব্রাশ মারলাম। ব্যাপারটা ঘটে গেল খুবই দ্রুত। মুহূর্তের মধ্যে গর্জে উঠলো পাকবাহিনীর আগ্নেয়াস্ত্রগুলো। ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটতে লাগলো পাকবাহিনীর বুলেট। এ সময় আমার হাতের এল-এম-জি ম্যাগাজিন শূন্য। মৃত্যু অবধারিত ভাবলাম। কিন্তু এমন আমাদের জোয়ানরা শত্রুদের উপর পিছন থেকে আক্রমণ করে, ফলে শত্রুরা ইতস্তত- বিক্ষিপ্তভাবে গুলি ছুড়তে থাকে। এমন সময়ে আমরা ক্রলিং করে পলায়ন করি। এভাবে আমরা মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাই।

৪ঠা ডিসেম্বর: ইঞ্জিনিয়ার নায়েক আবুল হোসেন- এর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধাকে নির্দেশ দিলাম যে তারা যেন সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পুলগুলি ধ্বংস করে দেয়। তাদের সাহায্যের জন্য প্রত্যেক জায়গায় এ্যামবুশ পার্টি পাঠানো হলো। রাতে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পুলগুলি ধ্বংস করা হলে পাকবাহিনী খুবই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং কুমিল্লার দিকে পালাতে থাকে। পলায়ন পর পাকসেনাদের সঙ্গে জায়গায় জায়গায় এ্যামবুশরত মুক্তিবাহিনীর খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ হয়।

৫ই ডিসেম্বর: হাবিলদার আব্দুল লতিফকে এক প্লাটুন মুক্তিফৌজ দিয়ে লাকসাম-নোয়াখালী সড়কে শত্রুদের পলায়ন রোধ করার জন্য পাঠাই। কিন্তু তখন ফিরে এসে জানালেন যে, আক্রমণের ভয়ে পাকবাহিনী রাস্তা ছেড়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে পলায়ন করেছে।

৬ই ডিসেম্বর: হাবিলদার আব্দুল মতিন খবর পাঠালেন যে লক্ষ্মীপুর ও রায়পুরে তুমুল যুদ্ধের পর ১০৮ জন রাজাকারকে নিহত করে লক্ষ্মীপুর সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করা হয়েছে এবং রায়পুরও মুক্তিবাহিনীর আয়ত্তাধীন। এ খবার পাবার পর আমার জোয়ানদের মনোবল অনেকগুণ বেড়ে যায়।

৭ই ডিসেম্বর: এই দিন নোয়াখালীর রাস্তায় রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ে হাজার হাজার আবালবৃদ্ধবণিতা। সকলের মুখে শ্লোগান আর শ্লোগান। হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা। নতুন সূর্যের উদয় হলো নোয়াখালীতে।

৩ রা ডিসেম্বর: প্রোগ্রাম অনুযায়ী ভোর ছ’টায় আমরা আক্রমণ করলাম সোনাইমুড়ি। রাজাকারদের সাথে গুলি বিনিময় হচ্ছে। এদিকে হাজার হাজার জনতা বিজয় উল্লাসে মেতে উঠেছে। অবশেষে ৬৩ জন রাজাকারকে নিহত করে সোনাইমুড়ি দখল করা হলো। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে বীর যোদ্ধা হাবিলদার নূর মোহাম্মদ এবং ছাত্রনেতা সালেহ আহমদ এ যুদ্ধে শহীদ হন। সোনাইমুড়ি মুক্ত হবার পর আমরা বজরা আক্রমণ করি এবং বজরা মুক্ত করে চৌমুহনী অভিমুখে রওনা হই। এখানেও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। চৌমুহনী আক্রমণের কয়েক ঘণ্টা পর বহু রাজাকার নিহত হয় এবং অবশিষ্ট রাজাকার আমাদের হাতে বন্দী হয়। চৌমুহনীতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়তে থাকে। এসময় নায়েক সুবেদার ওয়ালীউল্লা ও শামসুল হক এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন এবং চৌমুহনী আক্রমণে সাহায্য করেন। এ সময় মেজর জাফর ইমাম চৌমুহনীতে তাঁর বাহিনী নিয়ে উপস্থিত হন এবং পরে যৌথ শক্তিতে মাইজদী আক্রমণ করে তা মুক্ত করা হয়।

এ যুদ্ধে আহত হয়ে আজও নায়েক সুবেদার ইসহাক ও হাবিলদার জালাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এভাবে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হয়। আমাদের এ যুদ্ধে জনসাধারণ যথেষ্ট সাহায্য করেন, বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয়, খাদ্য ও অন্যান্য সাহায্য করে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেন। বাংলার মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে এটাই প্রমাণ করেছে যে তারা কাপুরুষ নয়। তারা সম্মুখসমরে যথেষ্ট দক্ষতার অধিকারী।

স্বাক্ষর: সুবেদার মেজর লুৎফর রহমান
১৮-০৯-১৯৭৩ ইং

Scroll to Top