সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার এ,কে এম ফরিদউদ্দিন

সশস্ত্র প্রতিরোধঃ ময়মনসিংহ
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৫। ময়মনসিংহ ও অন্যান্য এলাকার সশস্ত্র প্রতিরোধের বিবরণ বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র ১৯৭১


<৯, ৫.১, ২১২-২১৬>
ময়মনসিংহ শহর ও অন্যান্য স্থানের প্রতিরোধ

সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার এ,কে এম ফরিদউদ্দিন
১০-১-১৯৭৫

 

বিগত ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে আমি আমার ইপিআর-এর ‘সি’ কোম্পানীসহ ২নং উইং হেডকোয়ার্টার ময়মনসিংহ ছিলাম।  

 

২৫শে মার্চ তারিখে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঢাকা ত্যাগ, টিক্কা খানের রেডিও ভাষন ও আদেশ এবং পাক সামরিক বাহিনীর পিলখানা, রাজারবাগ আক্রমনের খবর ময়মনসিংহে পৌছাঁর সাথে সাথে ময়মনসিংহের ইপিআর-এর বাঙালি যুবকরা তাদের ভবিষ্যৎ বুঝতে পারে। অন্য দিকে তৎকালীন ২নং ইপিআর উইং এর- কমান্ডার ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসের জোয়ানদিগকে আরাম করার আদেশ হইতে পরিস্থিতি আরো পরিস্কার হইয়া উঠে যে বাঙালিদের ভাগ্যাকাশে ঘনঘটার ছায়া জুড়িয়া বসিয়াছে।

 

২৭-৩-৭১ তারিখে সকাল বেলা ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস আমাকে অফিসে ডাকাইয়া আদেশ দেন যে, আপনারা প্রায় এক মাস যাবৎ ষ্ট্যাণ্ডবাই ডিউটি করিতেছেন, এখন ষ্ট্যাণ্ডডাউন করিয়া আরাম করেন। তাহাতে আমি তার সাথে একমত না হওয়ায় দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। ঐ সময় একটি জীপে করিয়া বেশ কিছু এম্যুনিশন ক্যাপ্টেন সাহেবের বাসায় নিয়া যাওয়ার সময় আমার মনে সন্দেহ আরো ঘনিভূত হয় যে, আমাদের উপর হামলা হইবে। তারপর আমি উইং হেডকোর্য়াটারের কয়েকজন বাঙালি এনসিও, যথা হাবিলদার আরিফ, হাবিলদার সিরাজ, হাবিলদার আহাম্মদ মিয়া এবং হাবিলদার আঃ হাকিমকে নিয়া একটি গোপন বৈঠক করিয়া সিদ্ধান্ত নিই যে, হাতিয়ার দেব না। এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে কোত হইতে হাতিয়ার এ্যামুনিশন আরও যাহা ছিল বাহির করিয়া জোয়ানদের মধ্যে বিতরণ করিয়া দেই এবং যে কোন পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য হুকুম দিই। সমস্ত বাঙালি জোয়ানরা নতুন করিয়া শপথ নিয়া মরণ পর্যন্ত হাতিয়ার দিবে না বলিয়া আমাকে আশ্বাস দেয়।

 

সারা দিন দুই পক্ষের লোকদের মধ্যে একটা অর্বণনীয় পরিস্থিতি বিরাজ করে। ইতিমধ্যে অবাঙালি ফোর্স, যাহাদের মধ্যে ইপিআর, এয়ার ফোর্স, জিডি ট্রুপস, আর্মি সিগন্যাল, মুজাহিদ ইন্সট্রাক্টর এবং আর্মি সিকিউরিটি মিলিয়া প্রায় ১৩৮ জন ছিল। তাহারা একটি গোপন বৈঠক করে। ইহার খবর পাইয়া বিকাল অনুমান ৪টার দিকে আমি দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ‘সি’ কোম্পানী, যাহা খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পে ছিল, তাহার কমান্ডার তৎকালীন মেজর নূরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনা করি। সমস্ত গোপনীয় সংবাদ, যাহা আমার জানা ছিল, তাহাকে অবগত করাই এবং আগে আমাদের এ্যকশনের জন্য পরামর্শ করি এবং তাহার সহযোগিতা কামনা করি। তারপর অনুমান সাড়ে ছয়টায় সময় ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসকে সাথে নিয়া আসিয়া আমার বাঙালিদিগকে ফল-ইন করিতে হুকুম দেন, কিন্ত আমি অল্প কিছু লোক যাহারা সামনে ছিল তাহাদেরকে একত্র করিয়া মেজর সাহেবকে আলাপ করিতে দেই। মেজর সাহেব বলেন যে একটি কোম্পানী বা একটি উইং কি করিয়া পাক আর্মির বিরুদ্ধে সন্দেহ প্রকাশ করিতে পারে বাচাঁর জন্য তৈরী হইতে পারে? যাহোক, মেজর সাহেব আমাদেরকে অভয় দেন যে, কোন বিপদ হবে না, ভুল চিন্তা করিবেন না। কিন্তু ঐ সময় আমি দেখিতে পাই যে, অবাঙালির ২০/২৫ জন মুজাহিদ কোতে ঢুকিয়া ডিউটি শুরু করিয়াছে। অন্যদিকে. তাহাদের কিছু জেসিও মেসে, কিছু অফিসের ভিতরে, কিছু ক্যাপ্টেন সাহেবের বাসায় এবং অন্যদিকে ২৫/৩০ জনের একটি গ্রুপ পেট্রোল ডিউটি আরম্ভ করিয়াছে। তখন কয়েকজন বাঙালি জোয়ান দৌড়াইয়া আমার নিকট আসিয়া বলে যে, আমরা কি করিব। অবস্থা খুবই খারাপ দেখিয়া আমি ওদেরকে নিজের জায়গায় থাকিতে আদেশ দেই এবং যে কোন মূল্যে কোয়াটার গার্ড নিজেদের আয়ত্বে রাখিতে আদেশ দেই।

 

অন্যদিকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানী যাহা পুকুর পারে ছিল তাহাদের মধ্যে নায়েক সুবেদার বড়–য়া এবং নায়েক সুবেদার মোশাররফ হোসেনকে (দুই জনই বাঙালি) ডাকাইয়া অবস্থা তাহাদেরকে জানাই এবং তাহাদের মনোভাব সর্তকতার সহিত অনুভব করি, যেহেতু তাহারাও আর্মি। এইভাবে রাত্রি সাড়ে নয়টার সময় আমি পরিস্কার বুঝিতে পারি যে, আমাদের উপর হামলা হইবে।  তাই আমি পরিস্থিতি সম্বন্ধে মেজর নুরুল ইসলামকে ডাক বাংলোয় খবর পাঠাই। কিন্তু কোন উত্তর পাওয়ার আগেই রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারোটার সময় অবাঙালিদের তরফ হইতে প্রথম ফায়ার আসে যাহাতে বাঙালি একজন জোয়ান আহত হয়। অমনি দুইদিকে হইতে তুম ুলভাবে আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন শুরু হয়। এই যুদ্ধ ২৭ তারিখ রাত্রি সাড়ে এগারোটা হইতে পরদিন বিকাল সাড়ে পাঁচ ঘটিকা পর্যন্ত ছিল। ইপিআর হেডকোয়ার্টারের দুই দিকের আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জনে সারা ময়মনসিংহ কাপিয়াঁ উঠে। এই দীর্ঘ আঠারো ঘন্টার যুদ্ধে  বাঙালিরা সংখ্যায় ছিল প্রায় ২২০ জন আর অবাঙালিরা ছিল ১৩৮ জন। সারারাত যুদ্ধ চলে। সকালের দিকে শহর ও গ্রাম হইতে প্রায় ১০/১৫ হাজার বাঙালি সিভিল লোক বাঙালিদের খাবার, পানীয় ও অন্যান্য যথাসম্ভব সাহায্য করে। অবাঙালিদের মধ্য হইতে ১২১ জন মারা যায় এবং বাকী সতর জন আমার নিকট আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হয়। যাহারা আত্মসমর্পণ করিয়াছিল তাহাদের মধ্যে সুবেদার মেজর জিন্নত খাঁ, নায়েক সুবেদার বোস্তান খাঁ, নায়েক সুবেদার খান বাহাদুর, হাবিলদার গোলাম হায়দার, হাবিলদার নাজির বাদশাহ প্রমুখ ছিল। যাহারা মারা যায় তাহাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস, একজন এয়ারফোর্সের অফিসারও ছিল। বাঙালিদের মধ্যে সিপাই দেলওয়ার, সিপাই রাজ্জাকসহ কয়েকজন আহত হন। দেলওয়ার পরে মেডিকেল কলেজে মারা যায়।

 

প্রকাশ থাকে যে, আমি সকাল সাড়ে আটটার দিকে উক্ত উইং- এর অধীনে বর্ডারে থাকা কোম্পানীগুলিকে একটি অয়ারলেস মেসেজ দ্বারা হেডকোয়ার্টারের পরিস্থিতি জানাই ।

(১) কোম্পানীগুলি ছিল সুবেদার হাকিম সাহেবের সাথে নকশী,

(২) সুবেদার জিয়াউল হক সাহেবের সাথে কইতরী এবং

(৩) সুবেদার আজিজুল হকের সাথে লেঙ্গুরায়।

আমি মেসেজে তাহাদেরকেও জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার অনুরোধ জানাই, যাহা তাহারা করেন।

 

এই যুদ্ধের পর আমি মোজাহিদ অস্ত্রাগার দখল করি এবং কোতে থাকা ১৪৭২টা রাইফেল, ২৮টি এলএমজি, বেশ কিছু ষ্টেনগান, এক লক্ষ পয়ত্রিশ হাজার ৩০৩ গুলি, প্রায় ছত্রিশ হাজার ৯ এমএম গুলি এবং আরো যুদ্ধসরঞ্জাম দখল করি, যাহা পরে তৎকালীন মেজর বর্তমানে মেজর জেনারেল কে,এম,শফিউল্লাহ সাহেবকে দেই।

 

এখানে উল্লেখ্য যে, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সি-কোম্পানীর সাহায্যে আমি চাহিলে সিনিয়র জেসিও বড়ুয়া বলেন যে মেজর সাহেবের বিনা হুকুমে সে আমাকে সাহায্য করিতে পারিবে না। তারপর নায়েক সুবেদার মোশাররফ হোসেন সকাল প্রায় নয়টার দিকে কিছু লোক নিয়া আমার সাথে যোগ দেয়, কিন্তু ঘন্টাখানেক পর আবার বিরত হইয়া যায়। অন্যদিকে মেজর নুরুল ইসলাম, তার সঙ্গী লেফটেন্যান্ট মান্নান সাহেবের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নাই। সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ছয়টার দিকে যখন আমি উইং-এর লোকেশন বদলী করার জন্য পুলিশ লাইনের ভিতর দিয়া যাইতেছিলাম তখন আমার ৪/৫ জন লোক মেজর সাহেবকে আমার সঙ্গে ঐ জায়গায় দেখা করাইলে জানিতে পারি যে মেজর সাহেব ব্রাক্ষপুত্র নদের ওপারে চলিয়া গিয়াছিলেন। আমি মেজর সাহেবকে ঘটনা পুরোপুরি বলিলে তিনি আমাকে বলেন যে, তাহার ব্যাটালিয়ান হেডকোয়ার্টার জয়দেবপুরে অয়ারলেসে আলাপ করার পর আবার আমার সঙ্গে দেখা করিবেন।  

 

রাত্রেই আমি পুলিশ, সিভিল ও আওয়ামী লীগের লোকজনের সাহায্যে আমার উইং-এর লোকেশন বদলী করিয়া রাবেয়া হাইস্কুলে নিয়া যাই, কারণ আমি অনুমান করি যে পরের দিন পাক বাহিনী খবর পাইলে হয়তো কোন এয়ার এ্যাকশন নিতে পারে। সিভিল লোকদের মধ্যে যাহারা অগ্রভাগে কাজ করিয়া আমাকে সাহায্য করেন তাহাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন এম-এন-এ (বর্তমান আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট) জনাব রফিক উদ্দিন ভূইয়াঁ, বর্তমানে লণ্ডনে এ্যাম্বাসেডর জনাব সৈয়দ সুলতান সাহেব, বর্তমান এমপি হাতেম আলী তালুকদার সাহেব প্রমুখ।

 

পরের দিন ২৯-৩-৭১ তারিখে সকাল বেলা আমি রাবেয়া হাইস্কুলে ইপিআর-এর লোকসহ বাংলাদেশের পতাকাকে গার্ড অব অর্নারের সাথে সালাম দিয়া পতাকা ছুঁইয়া নতুন করিয়া শপথ নিই যে আমরা আমরণ যুদ্ধ করিব। উল্লেখ্য যে পতাকা তুলিয়াছিল হাবিলদার নিয়াজ। কারণ এখন আর গত্যন্তর নাই। অনুমান বেলা এগারোটার দিকে যখন আমি খাগডহর-এর দিকে যাচ্ছিলাম নতুন বাজারের মোড়ে একজন সাদা পোষাকে আমাকে পরিচয় দেয় যে তিনি বেলুচ রেজিমেন্টের একজন বাঙালি ক্যাপ্টেন এবং আমার সঙ্গে যোগ দিতে চান। কিন্তু আমি তাকে বিশ্বাস করতে না পারায় পরে দেখা করতে বলি, কারণ আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম। একটু পড়েই মেজর নুরুল ইসলাম সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি বলেন যে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ময়মনসিংহের ইপিআর-এর যুদ্ধের কথা শুনিয়াছি। তাহারা বৈকালিক দিকে ময়মনসিংহে পৌঁছাইতেছে যাহাতে কয়েকজন বাঙালি অফিসার রহিয়াছেন।  

 

সন্ধ্যার পর ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট ময়মনসিংহের রাজবাড়ীতে একত্রিত হয়। এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ লিডারসহ একটি গোপন বৈঠক করিয়া ময়মনসিংহের প্রতিরক্ষা এবং ঢাকা আক্রমন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমি নকশী কোম্পানীকে জামালপুরের দায়িত্বে, করাইতলা কোম্পানীকে সদর পশ্চিম দিকের দায়িত্বে এবং লেংগুরা কোম্পানীকে সদর দক্ষিন দিকের দিয়া আমার হেডকোয়ার্টার কোম্পানী ও উইং হেডকোয়ার্টারসহ নরসিংদী হইয়া ঢাকার পূর্বদিক দিয়া আক্রমন চালাইবার সিদ্ধান্ত নিই।

 

৩০-৩-৭১ তারিখে মেজর শফিউল্লাহ সকাল ৮ ঘটিকার সময় আমার ইপিআর ফোর্সের সাথে রাবেয়া হাইস্কুলে আলাপ করেন এবং তাহাদের ঢাকার দিকে রওনা হওয়ার জন্য বলেন। ঐ দিন ঐ সময় আমি আমার নিকট ক্যাপচার করা ১৪৭০ টি রাইফেল, ২৮টি এলএমজি, বহু ষ্টেনগান, এক লক্ষ পয়ঁত্রিশ হাজার ৩০৩ গুলি, ছত্রিশ হাজার  ৯এমএম গুলি ইত্যাদি তাহার নিকট হস্তান্তর করি। অন্যদিকে, বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানীর তৎকালীন ক্যাপ্টেন (বর্তমানে লেঃ কর্ণেল) নাসিম সাহেবের নের্তৃত্বে ট্রেনে ভৈরব হইয়া ঢাকার পথে রওনা দিই। বেলা সাড়ে বারোটার সময় এই স্পেসাল ট্রেন ময়মনসিংহ ষ্টেশন ত্যাগ করে। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান আমাদের দলে যোগ দেন। রাত্রি প্রায় এগারোটার দিকে ভৈরব পৌছালে ক্যাপ্টেন নাসিম সাহেব তার কোম্পানীসহ ভৈরব ষ্টেশনে নামিয়া যাইতে থাকিলে আমি তাকে বলি যে, ঢাকায় যাইবেন না? তিনি উত্তরে বলেন যে, সকালবেলা একটা কোম্পানী আপনি নরসিংদীতে পাবেন। আপনি গিয়া আগের দিকে ব্যবস্থা করেন।

 

আমরা সকালের দিকে নরসিংদীতে পৌঁছাইয়া সড়ক পথে ঢাকার দিকে রওনা হই। কিন্তু ডেমরা ঘাট পাক ফোর্সের দখলে জানিতে পারিয়া পাঁচ দোনা বাজার হইতে আমরা ঢাকা শহরের প্রায় ১২ মাইল দূরে ভাঙ্গা নামক স্থানে জঙ্গলে শীতালক্ষ্যা নদীর পূর্বতীরে সন্ধ্যার পর অবস্থান নিই। এই ৩১-৩-৭১ তারিখের। এখানে আলীজান জুট মিলের ম্যানেজার জনাব মিজানুর রহমান সাহেবের নিকট হইতে আমরা খুব সাহায্য পাই।

 

এদিকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী ক্যাপ্টেন সাইগলের নের্তৃত্বে আমাদের সঙ্গে নরসিংদীতে ৩১-৩-৭১ তারিখে বেলা প্রায় দুইটার দিকে যোগ দেয়। ডেমরার পাক ফোর্স যাহাতে আমাদের ক্ষতি না করিতে তার দায়িত্ব বেঙ্গল রেজিমেন্ট কোম্পানীকে দেওয়া হয়। এবং সিদ্ধান্ত হয় যে, তাহারা ঢাকা-নরসিংদী পাকা রাস্তায় ফোর্সের যে কোন অগ্রাভিযান প্রতিরোধ করিবে। আমরা ঢাকার পূর্বদিকে আক্রমন করিব। সেইভাবে ১-৪-৭১ তারিখে রাত্রিতে আমি ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানসহ ৩“ মর্টার দ্বারা ঢাকায় ক্যান্টনমেন্ট এরিয়াতে ইপিআর-এর ৬০ জন লোক মিলিয়া আক্রমন করি যাহাতে পাক ফোর্সের গাড়ী ও অন্যান্য যুদ্ধসরঞ্জাম ধ্বংস করি। এই যুদ্ধ চালাইতে আমাদের সাহায্য করেন আওয়ামী লীগ নেতা জনাব লাল মিয়া সাহেব। তাহারই পরিপ্রেক্ষিতে পাক ফোর্স তাহাদের ক্ষতিপূরণ করিবার জন্য ৩-৪-৭১ তারিখে রেডিওতে হুকুম জারি করে ঢাকার সমস্ত বাস ও ট্রাক রমনা মাঠে ড্রাইভারসহ রির্পোট করিতে। এর আগে আকাশবানী কলিকাতা হইতে এ খবর প্রচার হইয়াছিল যে, একটি বিরাট মুক্তি বাহিনী দল নরসিংদী হইয়া ঢাকার দিকে অগ্রসর হইতেছে। আমরা ভাঙ্গা হইতে পরপর দুইদিন ও রাত্রিতে আক্রমণাত্মক এ্যাকশন চালাইলে পাক ফোর্স তাহার ডেমরা ঘাটির শক্তি বৃদ্ধি করিতে থাকে বলিয়া সংবাদ পাই। আরো জানিতে পারি যে, আমাদের বেইসের উপর আক্রমন করিবে। কিন্তু আমাদের ২২ জন লোকের একটি দল গেরিলা পদ্ধতিতে ঢাকার তৎকালীন পাক মোটর বর্তমানে বাংলা মোটরে ৪-৪-৭১ তারিখের রাত্রিতে এবং ঢাকা ডেমরা রোডে ৫-৪-৭১ এ রাত্রিতে দুই জায়গায় সরকারী গাড়ীসহ বেশ কিছু পাক ফোর্সকে মারে। এই দুইটা সফল অপারেশনে অংশগ্রহণ করিয়াছিল হাবিলদার হাকিম, সিপাই নান্নু মিয়া, সিপাই আফতাব, সিপাই ক্লার্ক মান্নান।

 

৩-৪-৭১ তারিখে বেলা অনুমান ১১/১২ টার সময় আমি একজন সিপাই এর মারফত সংবাদ পাই যে, ঢাকায় বহু ইপিআর মারা পড়িয়াছে। এবং প্রায় ১০০ লোক ঢাকার জিঞ্জিরায় সুবেদার গনি সাহেবের সাথে আছে। আমি একজন লোক মারফত চিঠি দিয়া গনি সাহেবকে আমার সহিত যোগদানের অনুরোধ জানাই। ৬-৪-৭১ তারিখে আমি নায়েক সুবেদার সুলতানের মাধ্যমে জানিতে পারি যে, সুবেদার গনি সাহেব নরসিংদীতে লোক নিয়া পৌঁছলে ঐ জায়গায় বিমান আক্রমন হয়। এবং তাহারা আবার ছত্রভঙ্গ হইয়া গিয়াছে। এবং অন্যদিকে বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানী নয়া ক্যাপ্টেন সাইগল ঢাকা-নরসিংদী রাস্তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়িয়া দিয়া নরসিংদী পার হইয়া পূর্ব দিকে চলিয়া গিয়াছে। এই সংবাদ শুনিয়া আমার লোকজনের মনোবল কমিয়া যায়। আমার ২০/২২ জন লোক তখনও ভাঙ্গা বেইস হইতে ঢাকায় অপারেশনে ছিল। অন্যদিকে ২-৪-৭১ তারিখে আমি নায়েক সুবেদার সিরাজের নের্তৃত্বে ৪০ জনের একটি প্লাটুন ঘোড়াশাল রেল ষ্টেশন এরিয়া প্রতিরক্ষার জন্য পাঠাই। ৬-৪-৭১ তারিখে বেঙ্গল রেজিমেন্ট চলিয়া যাওয়ার সংবাদ পাইয়া আমি তাহাদেরকে আমার সঙ্গে পাঁচদোনায় ফেরত ডাকিয়া পাঠাইয়া নিজে ভাঙ্গার লোকজনসহ পাঁচদোনার শীলমন্দির নামক গ্রামে প্রতিরোধ ব্যবস্থা করি, অর্থাৎ ডিফেন্স লাগাই। অন্যদিকে খবর পাই যে, পাক ফোর্স ডেমরায় জমা হইয়া আমাদের উপর আক্রমন করার জন্য প্রস্তুতি নিতেছে।

 

৭-৪-৭১ তারিখে রাত্রে জানিতে পারি যে, পাক ফোর্স সকাল বেলা আমাদের উপর হামলা করিবে। তাই পাঁচদোনার আগে ১২-১৪জন লোক দিয়া একটি এ্যামবুশ পার্টি লাগাই যাহাতে সিপাই নান্নু, মান্নান, হাকিম ছিল। ঠিক ৮-৪-৭১ তারিখ সকাল আনুমানিক সাড়ে ছয়টায় পাক ফোর্স অগ্রসর হইতে থাকিলে এ্যামবুশ পার্টি একযোগে ৪টি এলএমজি দ্বারা আক্রমন চালায় যাহাতে পাক ফোর্সের প্রায় ১৫৫ জনের মতো লোক হতাহত হয় এবং কয়েকটি গাড়ীও নষ্ট হয়। পাক ফোর্স ঐদিন আর অগ্রসর হয় নাই।

 

৯-৪-৭১ তারিখ অনুমান নয়টার সময় পাক ফোর্স এয়ার ও আর্টিলারী সমর্থনপুষ্ট হইয়া আমাদের উপর হামলা চালায়। অনুমান এক হইতে সোয়া ঘন্টা যুদ্ধের পর পাক ফোর্স যাহাতে ৩১ বেলুচ রেজিমেন্ট ছিল-আক্রমন ছাড়িয়া দিয়া পাঁচদোনা হইতে পিছে চলিয়া যায়। যুদ্ধ কিছুটা স্মিতিম হইয়া পড়ে কিন্তু আর্টিলারী ফায়ার চলিতে থাকে। আমাদের তরফ হইতে চলিতে থাকে তিন ইঞ্চি মর্টার। বেলা আনুমানিক ৫ ঘটিকার সময় পাক ফোর্স আবার আমাদের উপর এয়ার ও আর্টিলারী দ্বারা সমর্থনপুষ্ট হইয়া দ্বিতীয়বার হামলা চালায়। এই যুদ্ধেও পাক ফোর্সের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। আমাদের দুটি মেশিনগান খারাপ হইয়া যায়। পাক ফোর্স এইবারও যথেষ্ট ক্ষতি স্বীকার করিয়া আক্রমন ছাড়িয়া দিয়া সন্ধ্যার সময় গোপালদী বাজারে চলিয়া যায়। এদিকে দুইবারের আক্রমনে আমাদের কিছু হাতিয়ার খারাপ হইয়া যায়। যাহা হউক সন্ধ্যার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে আমরা এই অবস্থা ছাড়িয়া ভৈরবের দিকে যাইয়া বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে মিলিবো। আশুগঞ্জে গিয়া বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পাওয়া যায়। এবং সেখানে হইতে কিছু বেঙ্গল রেজিমেন্টসহ ১৩-৪-৭১ তারিখে রামনগর পুলের নিকট আর একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়িয়া তোলা হয়। কিন্তু ১৪-৪-৭১ তারিখে সূর্যাস্তের আগে হইতেই এয়ার ও আর্টিলারী সমর্থনপুষ্ট হইয়া পাক ফোর্স হামলা চালায় এবং দুপুর ১২ টার আগেই ঐ ডিফেন্স নষ্ট হইয়া যায় এবং এখানকার লোকজন ছত্রভঙ্গ হইয়া যায়। কিছু লোক মেঘনা পার হইয়া সিলেট জেলার ভিতর চলিয়া যায়।

 

আমি কিছু সংখ্যক লোকসহ কিশোরগঞ্জ হইয়া ময়মনসিংহে যাই, কারণ আমার ছেলেপেলে ঐখানে ছিল। তারপর ১৫-৪-৭১ তারিখ বিকালবেলা আমি মুক্তাগাছা হইয়া ময়মনসিংহ জেলার মধুপুরে জিয়াউল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করিলে জানিতে পারি যে,  টাঙ্গাইলের আগে জার্মুকী এলাকায় নায়েক সুবেদার হারিসের নের্তৃত্বে ইপিআর দলের সঙ্গে পাক ফোর্সের তুমুল যুদ্ধ হয় এবং দুই দিকের ভীষন ক্ষতি হয়। তাহাতে ২০/৩০ জন ইপিআর মারা যায়।

 

পরদিন ১৭-৪-৭১ তারিখের খুব সকাল হইতে পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের ৪টি জঙ্গি বিমান ভীষনভাবে ময়মনসিংহ শহর এবং অন্যান্য এলাকায় আক্রমন চালায় যাহাতে কিছু সিভিল লোক শম্ভুগঞ্জ ঘাটে মারা যায় এবং কয়েকটি বাস ও দোকানঘর পুড়িয়া যায়। তাহা ছাড়া মধুপুর ও জামালপুরেও বিমান আক্রমন হইয়াছে বলিয়া সংবাদ পাই।

 

তারপর আমরা আমাদের অবস্থানে যে কয়েকজন লোক ছিল তাহাদের নিয়া বর্ডারে করইতলী হেডকোয়ার্টারে ফুলপুর ও হালুয়াঘাটের মাঝামাঝি সায়চাপুর ঘাটে ডিফেন্স তৈয়ার করি। কিন্তু ২২/২৩ তারিখে পাক ফোর্স আবার এয়ার ও আর্টিলারী দ্বারা সমর্থনপুষ্ট হইয়া আক্রমন চালায় সকালের দিকে। সেখানে আমরা অতি অল্প সময় টিকিতে পারি। ২৩-৭-৭১ তারিখে আমি আমার সঙ্গী লোকসহ করইতলী ক্যাম্পে থাকাকালীন সুবেদার হাকিম সাহেব আসিলে তাহাকে উইং-এর ভার দিয়া আমি আমার ফ্যামিলিসহ হিন্দুস্থানের ভিতর দিয়া গাউছূয়া পাড়া হইতে ডালু হইয়া আমরা বাংলাদেশে ঢুকিয়া বহু কষ্টে আমার ফ্যামেলি বাড়ী পৌঁছাইয়া দিয়া আগরতলা কোনাবন বর্ডার দিয়া ঢুকিয়া পুরানো ফোর্সের সাথে ৩ সেক্টরের অধীনে বেলুচরা সাবসেকটরে যাইয়া যোগদান করি। সেখানে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান সাহেব ছিলেন। তারপর ঐ সব সেক্টরের ১৬-৫-৭১ হইতে যুদ্ধে লিপ্ত থাকি।

Scroll to Top