সাক্ষাৎকারঃ লেঃ জেনারেল (অবঃ) মীর শওকত আলী

        শিরোনাম সূত্র তারিখ
৯। ৫নং সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধ সম্পর্কে বিবরণ একাত্তুরের রণাঙ্গন- শামসুল হুদা চৌধুরী .১৯৭১

 

<১০, ৯, ২৮৩-২৮৭>
সাক্ষাৎকারঃ লেঃ জেনারেল (অবঃ) মীর শওকত আলী*

 

প্রশ্নঃ একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে আপনি কখন কিভাবে কাজ শুরু করলেন?

উত্তরঃ      প্রথমে আমি জেনারেল জিয়া (তৎকালীন মেজর)- এর সাথে এক নম্বর সেক্টরে সেকেন্ড-ইন কমান্ড অর্থাৎ দুই নম্বর হিসেবে কাজ শুরু করি। ৩০শে মার্চ, ’৭১-এর পর জেনারেল জিয়া আমার সাথে আর ছিলেন না। তিনি রামগড় হয়ে সীমান্তের ওপারে চলে গিয়েছিলেন। কাজেই ৩০শে মার্চের পর থেকে উল্লিখিত সেক্টরের পুরো বাহিনীর কমান্ড আমার হাতে এসে পড়ে। আমি, বিডিআর, ছাত্র-জনতা, এবং আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক দল নিয়ে গঠিত বাহিনী নিয়ে ২রা মে, ’৭১ বিকেলে আমরা সীমান্তের ওপারে চলে গিয়েছিলাম। কিছুদিন পর জেনারেল ওসমানী সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, ‘সিলেট এলাকায় আমাদের কোনও সেক্টর খোলা হয়নি এবং সিলেটের সুনামগঞ্জ, ছাতক এবং সালুটিকর- এইসব এলাকায় অনেক বিডিআর এবং সৈন্য বিশৃংখল অবস্থায় আছেন। কাজেই তিনি আমাকে অবিলম্বে শিলং চলে যেতে বললেন। তিনি নির্দেশ দিলেন ওখান থেকে আমি ছাতক এবং সুনামগঞ্জ এলাকায় গিয়ে যেন যুদ্ধ সংগঠন করি।

প্রশ্নঃ আপনার আনুষ্ঠানিক নিযুক্তি এবং সেক্টর সম্পর্কে ব্যাখ্যা দান করুন।

উত্তরঃ সরকার গঠিত হওয়ার পর আমাকে পাঁচ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত করা হলো। এলাকা দেয়া হলো ডাউকী থেকে সুনামগঞ্জের বাঁ দিকে বড়ছড়া নামক স্থান পর্যন্ত। এক কথায় বলা যায় ডাউকী থেকে ময়মনসিংহের সীমান্ত পর্যন্ত ছিল আমার সেক্টরের সীমানা। সিলেটে গিয়ে আমি দেখলাম আমাদের লোকজন খুব বিশৃংখল অবস্থায় আছেন। তাদের জন্য ওখানে না ছিল কোনও রসদপত্র, না ছিল কোনও যুদ্ধ সংগঠন।

আমি আমার এলাকাটিকে পাঁচটি সাব-সেক্টরে ভাগ করে দিয়েছিলাম। এই সাব সেক্টরগুলি ছিল ডাউকী, ভোলাগঞ্জ, শেলা, বালাত এবং বড়ছড়া, আমি বুঝলাম যে বিদেশের মাটিতে বসে দেশে যুদ্ধ করা যায় না। কাজেই সবদিকে আক্রমন চালিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জায়গা করে নেয়াই আমি আমার প্রধান কর্তব্য মনে করলাম। এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সীমান্তের দশ মেইল অভ্যন্তরে আক্রমণ পরিচালনা করলাম এবং আমরা সফল হলাম। এক পর্যায়ে আমরা সুরমা নদীর উত্তর ভাগে পুরা অংশ আমাদের দখলে নিয়ে এলাম। আমরা আমাদের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করলাম বাঁশতলায় (ছাতকের উত্তরে বাংলাদেশেরই একটি এলাকা)। সিলেট থেকে নদীপথে যেসব ছোট ছোট বার্জ এবং ছোট ছোট জাহাজ রসদপত্র নিয়ে ঢাকার দিকে যেতো সেগুলিকে আমরা পথে ধরতাম এবং রসদপত্রাদি কেড়ে নিয়ে কিছু আমাদের কাজে লাগাতাম এবং কিছু বাংলাদেশ হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিতাম। সেখান থেকে এসব রসদপত্র অন্য সব সেক্টরে চলে যেতো।

প্রশ্নঃ আপনার এই সংগঠনের পর্যায় কোন মাস থেকে শুরু হয়েছিল?

উত্তরঃ হুবুহু দিন-তারিখ আমার মনে নেই, তবে জুন কিংবা অনুরূপ সময় হতে পারে।

 

প্রশ্নঃ শুরুতে আপনার সৈন্যসংখ্যা কতজন ছিল? তখন নতুনদের প্রশিক্ষণের কি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন?

উত্তরঃ প্রথমে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, বিডিআর, পুলিশ এবং মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহী কিছু ছাত্র-জনতাসহ প্রায় চারশত লোক পেলাম। বর্ডারের ওপাররে এবং বাঁশতলায় আমরা ট্রেনিং ক্যাম্প করলাম। ভারত থেকে দু’একজন জেনারেল এসেছিলেন, তারাও কয়েকটি ট্রেনিং ক্যাম্প সংগঠন করলেন। দেশের অভ্যন্তরে থেকে যারা ওখানে গিয়েছিলেন তাদের মধ্য থেকে শক্ত সমর্থদের বেছে নিয়ে ট্রেনিং দেয়া হলো। আস্তে আস্তে বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে এই সংখ্যা প্রায় বার হাজারে গিয়ে দাঁড়ালো।

প্রশ্নঃ সরকার গঠিত হওয়ার পরের কথা বলুন।

উত্তরঃ সরকার গঠিত হওয়ার পর আমাকে সিলেট পাঠানো হলো ৫নং সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে। এলাকাটি ছিল দুর্গম। গাড়ী চলাচল করতে অসুবিধা হতো। সবটাই ছিল হাওড় এবং বিল এলাকা। সুনামগঞ্জ-ছাতক এলাকায় হয় নৌকা নতুবা পায়ে হেঁটে, সাঁতার কেটে এদিক ওদিক চলাচল করতে হতো। এসব জায়গায় সাংবাদিকও তেমন আসতেন না। সরকারের পক্ষ থেকেও লোকজন তেমন আসতেন না। একবার একজন কর্মকর্তা এসেছিলেন। তিনি হলেন নুরুল কাদের খান, যুদ্ধকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্থাপন সচিব। তিনি শিলং পর্যন্ত এসেছিলেন এবং আমার সাথে রণাঙ্গন পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেছিলেন। তিনি পায়ে হেঁটে আমার এলাকার গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গনসমূহ পরিদর্শন করেছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ সাহেবও একবার এসে আমাকে দেখে গিয়েছিলেন। তিনিও পায়ে হেঁটে আমার সেক্টরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন।

প্রশ্নঃ সেক্টর বলতে কোন পর্যন্ত বুঝাচ্ছেন?

উত্তরঃ      বাংলাদেশের ভিতর বাঁশতলা বলে একটা জায়গা আছে। তাজউদ্দীন সাহেব ওখানে এসেছিলেন।

প্রশ্নঃ মুক্তিযোদ্ধাদের আপনি কোথায় এবং কিভাবে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন?

উত্তরঃ      বাংলাদেশের ভিতরে আমাদের অনেকগুলি ক্যাম্প ছিল। সেসব ক্যাম্পে আমাদের সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। আবার ভারতের অভ্যন্তরে সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায়ও কিছু প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ছিল। সেসব ক্যাম্পে ভারতীয় সৈন্যরা প্রশিক্ষন দিতেন।

কাজেই মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণের দু’টি উৎস ছিল। একটি ছিল সেটা আমি নিজে সংগঠন করে বাংলাদেশ থেকে এনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতাম। আর একটি ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর মাধ্যমে আমাদের সরকার সরাসরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে মুক্তিযোদ্ধাদের পৃথক পৃথকভাবে আমাদের কাছে পাঠাতেন।

প্রশ্নঃ জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে কমান্ডার-ইন-চীফ হিসেবে ঘোষনা করার পর আপনি কিভাবে তার সাথে সম্পর্ক চালিয়ে গিয়েছিলেন।

উত্তরঃ আগেই বলেছি জেনারেল ওসমানী সাহেবের সাথে সর্বপ্রথম আমার দেখা হয়েছিল রামগড়ে। তবে এর আগেও ওয়ারলেসে দু’একবার তাঁর নির্দেশ আমি পেয়েছি মহলছড়িতে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায়। তখন আমি বড় রকমের একটি যুদ্ধে লিপ্ত ছিলাম। সে সময় তিনি আমাকে রামগড়ে চলে আসতে বলেছিলেন। আমি তাঁকে জানিয়ে ছিলামঃ পুরো পার্বত্য চট্টগ্রম এলাকা আমার দখলে আছে কাজেই আপনারা কেন পার্বত্য এলাকায় চলে আসছেন না? তিনি পরামর্শ দিলেনঃ এটা ঠিক হবে না। আমরা সবাই মিলে আবার নতুনভাবে সংগঠন করে যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। জেনারেল ওসমানী সাহেবের নির্দেশানুযায়ী মহালছড়ির যুদ্ধের পর আমি রামগড়ে চলে গেলাম। জেনারেল ওসমানী ওপার থেকে রামগড়ে এলেন। সেখানেই বাংলাদেশের মাটিতে তার সাথে তার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল। জেঃ ওসমানী আমাকে খুব প্রশংসা করলেন এবং বললেনঃ আরো দু’দিন রামগড় আটকে রাখতে হবে’। তারিখটি ছিল ৩০শে এপ্রিল, ১৯৭১। আগেই বলেছি ২রা মে বিকেলে আমরা ভারতীয় এলাকায় চলে গিয়েছিলাম। রামগড়কে আরো দু’দিন আটকিয়ে রাখতে বলার কারণ ছিল আমাদের মুক্তিবাহিনী যেসব রসদপত্র নিয়ে ছিলেন সেগুলি পার করার জন্য এবং সীমান্তে আটকে পড়া নিরীহ জনগণকে নিরাপদে ভারতে পার করে যাওয়ার জন্য দু’দিন সময়ের প্রয়োজন ছিল।

প্রশ্নঃ মুক্তিযুদ্ধে যে আপনারা জয়ী হচ্ছিলেন, এটা কখন বুঝতে পেরেছিলেন?

উত্তরঃ অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে। একটা সময় খুব খারাপ এসেছিল জুন-জুলাই মাসে। তখন অনেকে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এমনকি আমাদের এমএনএগণ পর্যন্ত বলতে শুরু করেছিলেনঃ ‘ভাই আর কি দেশে ফিরে যাওয়া যাবে?’ কিন্তু আমরা হতাশায় ছিলাম না। আমরা সব সময় আশাবাদী ছিলাম। কারণ, এতে জড়িত ছিল বাঁচামরার প্রশ্ন। হয় দেশ উদ্ধার করতে হবে, নইলে দেশ-জাতি সবই গেল। তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে আমরা জয়ের দিকে যাচ্ছি এবং আমরা জিতবই- দু’মাস লাগতে পারে, ছয়মাস লাগতে পারে, আমরা আমাদের নিজেদের শক্তিতে জিতব। এজন্য ভারতীয় সৈন্যের প্রয়োজন হবে না।

প্রশ্নঃ পাকিস্তানী বাহিনীর তুলনায় আপনাদের সৈন্যবলতো খুব কম ছিল, অস্ত্রও ছিল খুবই সীমিত। আপনাদের রণকৌশল সম্পর্কে কিছু বলুন।

উত্তরঃ রণকৌশন যা সাধারণ হওয়া উচিৎ, তাই ছিল। শুরু দিকে যেহেতু আমরা ছোট ছোট দলে গিয়েছিলাম, তাই তখন গেরিলা রণকৌশলকে আমরা প্রধান অবলম্বন হিসাবে বেছে নিয়েছিলাম। কারণ যুদ্ধের নিয়মই হলো যখন কোন বড় শত্রুর সাথে আপনি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চান, তখন আপনি যদি চিরাচরিত যুদ্ধনীতি ভঙ্গ করে যুদ্ধ করতে হবে, অর্থাৎ গেরিলা যুদ্ধ করতে হবে। এই পদ্ধতিতে আমরা শত্রুদের বড় বড় বাহিনীর উপর আচমকিতে গুলি চালিয়ে পালিয়ে যেতাম। তাতে শত্রুপক্ষের হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশি হতো। অপরপক্ষে আমাদের কিছু হতো না। আমাদের মূল রণকৌশলই ছিল, এই গেরিলা পদ্ধতিতে পাকিস্তান বাহিনীকে রোজ একটু একটু করে আঘাত করে ওদের শক্তি কমিয়ে দেয়া এবং ওদের অসংগঠিত করে দেয়া, ওদের রসদপত্র নষ্ট করে দেয়া ইত্যাদি। আমরা জানতাম যে একটা সময় আসবে যখন আমরা নিয়মিত বাহিনী গঠন করে ওদের আক্রমণ করে আমাদের দেশ পুনরুদ্ধার করতে পারব।

প্রশ্নঃ শত্রুবাহিনী থেকে আপনারা কি পরিমান অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছিলেন?

উত্তরঃ প্রচুর। শুরর দিকে আমাদের যা কিছু অস্ত্রশস্ত্র ছিল তাই দিয়ে যুদ্ধ করতাম। পরের দিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা অনেক অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম। যখন আমরা আকস্মিক আক্রমণ চালাতাম তখন তারা পালিয়ে যেতো। তারা পালিয়ে যাওয়ার পর যা অস্ত্রশস্ত্র পড়ে থাকতো সব আমরা নিয়ে নিতাম।

প্রশ্নঃ ৩রা ডিসেম্বর ’৭১ পাকিস্তান এবং হিন্দুস্তানের সাথে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষনার পর আপনার রণকৌশলের কোন পরিবর্তন হয়েছিল কি?

উত্তরঃ হ্যাঁ। তখন আমরা চিরাচরিত যুদ্ধে (কনভেনশনাল ওয়ার) লিপ্ত হয়ে গেলাম। ৩রা ডিসেম্বরের পর প্রথমে আমরা দখল করলাম টেংরা টিলা। তারপর দখল করলাম, ছাতক, তারপর সুনামগঞ্জ। তারপর আমরা সমস্ত বাহিনী সুরমা নদীর এপারে পার করে সোজা সিলেটের দিকে ধাবিত হলাম। আমরা লামাকাজি পর্যন্ত দখল করলাম। তখনই পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের কথা ঘোষিত হয়ে গেল।

প্রশ্নঃ জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরাকে ইষ্টার্ন কমান্ডারের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করার পর মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর কি ভূমিকা হয়েছিল?

উত্তরঃ জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরাকে কমান্ডে দেয়ার পর জেনারেল ওসমানীই আমাদের জানালেন যে এখন জেনারেল আরোরার নেতৃত্বে যৌথ কমান্ড হচ্ছে। কাজেই আমাদের এলাকায় নিযুক্ত ভারতীয় জেনারেলগণের সাথে ঐ সময় থেকে সংযোগ রক্ষা করে যুদ্ধ করার জন্য তিনি আমাদের পরামর্শ দিলেন।

প্রশ্নঃ জেনারেল ওসমানী সাহেব আর কমান্ড করতেন না?

উত্তরঃ করতেন তবে সরাসরিভাবে আমাদের এমন কোনও বেতারযন্ত্র ছিল না সব সময় যোগাযোগ রক্ষা করে চলার জন্য।

প্রশ্নঃ সম্মিলিত মিত্র ও মুক্তিবাহিনী মিলে ৩রা ডিসেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর অর্থাৎ বিজয়ের পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত আপনারা কিভাবে যুদ্ধ করলেন এবং কিভাবে ঢাকা প্রবেশ করলেন?

উত্তরঃ যুদ্ধনীতির কথা তো ইতিমধ্যেই বললাম। ঢাকার এলাকায় প্রবেশকালে কোন কোন এলায়কায় মুক্তিবাহিনী ছিলেন। আবার অনেকগুলো জায়াগা ছিল যেখানে ভারতীয় বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন গিয়েছিলেন। এছাড়া মূল সিলেট এলাকায় ভারতীয় বাহিনী তাদের ব্যাটালিয়ন নিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু সুনামগঞ্জ, টেংরাটিলা, ছাতক এসব এলাকাতে একমাত্র মুক্তিবাহিনীই এককভাবে প্রবেশ নিয়েছিলেন।

প্রশ্নঃ ঢাকার দিকে কারা এগিয়েছিলেন?

উত্তরঃ ঢাকা দিকে মেজয় হায়দার ছিলেন। যেহেতু আমি সিলেট সেক্টরে ছিলাম কাজেই এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানা নেই।

প্রশ্নঃ আপনার বাহিনীতে মোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কত ছিল?

উত্তরঃ শেষের দিকে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত বিশ-পঁচিশ হাজার হয়েছিল।

প্রশ্নঃ তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা কতজন ছিল বলে আপনার ধারণা?

উত্তরঃ দশ-বার হাজার, বাকী দশ-বারো হাজার ছিল তালিকার বাইরে।

প্রশ্নঃ ভারতের মাটিতে আপনি জেনারেল (তৎকালীন মেজর) জিয়াসহ এক সাথে কতদিন যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন?

উত্তরঃ প্রায় মাসাধিক কাল। ২রা মে থেকে জুনের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত।

প্রশ্নঃ মেজর জিয়া কোথায় গেলেন?

উত্তরঃ জেনারেল ওসমানী সাহেব তাকে ‘জেড’ ফোর্স সংগঠনের ভার দিলেন। জিয়া সাহেব ময়মনসিংহের উত্তরে তুরা নামক স্থানে স্থাপন করেছিলেন তার জেড ফোর্সের প্রধান কেন্দ্রস্থল।

প্রশ্নঃ এবার রণাঙ্গনের দু’একটি অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই। আপনারা ঘুমাতেন কি করে?

উত্তরঃ মাটিতে। কখনো গাছতলায় কখনো বাঁশের খাঁচায়, এমনি মাচাং বানিয়ে উপরে খড় দিয়ে ঢেকে দিতাম। সাধারণত রাতে ঘুমানো সম্ভব হতো না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দু’টি অপারেশন-এর ফাঁকে দিনের বেলায় কিছু সময় ঘুমিয়ে নিতাম। সাধরণতঃ সৈনিকের পোশাকেই ঘুমিয়ে পড়তাম। সৈনিকের পোশাক বলতে  একটি খাঁকি হাফপ্যান্ট এবং পায়ে একজোড়া বুটই আমার পরনে থাকত। এ প্রসঙ্গে আপনাকে একটি ঘটনা বলি। আমি রামগড় থেকে সীমান্ত অতিক্রম করার পর (২রা মে,’৭১ থেকে জুন’৭১- এর মাঝামাঝি সময়) জেনারেল ওসমানী সাহেব গিয়েছিলেন আমাদের দেখতে। আমি তখন অপারেশনে ব্যস্ত। আমার পরনে শুধু একটি খাঁকি হাফপ্যান্ট এবং পায়ে একজোড়া বুট ছিল। গায়ে কোন গেঞ্জি পর্যন্ত ছিল না। মাথা থেকে সমস্ত শরীর ছিল ধুলাময়। খবর পেয়ে ঐ অবস্থায়ই জেনারেল সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম। এই একটি মাত্র ঘটানা থেকেই অনুমান করতে পারেন কি অবস্থায় আমরা যুদ্ধ করেছি।

প্রশ্নঃ রণাঙ্গনে একনাগাড়ে কত সময় পর্যন্ত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছিলেন?

উত্তরঃ তিনদিন তিনরাত।

প্রশ্নঃ কোথায়?

উত্তরঃ রামগড়ের উলটা দিকে সাবরুম নামক স্থানে। মে’৭১ থেকে জুন’৭১-এর মাঝামাঝি সময়ে।

প্রশ্নঃ সবচাইতে ভয়াবহ যুদ্ধ আপনি কোথায় করেছেন?

উত্তরঃ সবগুলিই ভয়াবহ, সবগুলিই লোমহর্ষক।

প্রশ্নঃ আপনি অত্যন্ত কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে গিয়েছেন, এমন দু’একটি ঘটনা জানতে চাই।

উত্তরঃ এটা একবার হয়নি। বহুবার হয়েছে। এটা বলে শেষ করা যাবে না। বহুবার পাকিস্তানী সৈন্যরা আমার নাকের ডগা দিয়ে অতিক্রম করে গিয়েছে, ধান ক্ষেতে আমি শুয়ে রয়েছি, হামাগুড়ি দিয়ে কিংবা বুকে ভর দিয়ে আমাকে বের হয়ে আসতে হয়েছে। বহুবার ঘেরাওর ভিতর পড়ে গিয়েছিলাম, আবার বের হয়ে গিয়েছি। এই যুদ্ধে একটা বিরাট প্রমাণ, বিরাট বিশ্বাস আল্লাহর উপর আমার বেড়ে গিয়েছে; আমি দেখলাম যে যার মৃত্যু নেই, সে মরতে পারে না- সে যেমন অবস্থায় থাকুক না কেন বেঁচে আসবে। অনেক সময় দেখা গিয়েছে সম্মুখের লোক মারা যায়নি, অথচ পিছনের লোক বেশি মারা গিয়েছে।

Scroll to Top