সাক্ষাৎকারঃ মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া

<৯, ১৬.৬, ৪৭৮-৪৭৯>

ঢাকায় গেরিলা অপারেশন-১
সাক্ষাতকারঃ মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী (মায়া) বীর বিক্রম

(‘রোববার’ বিজয় দিবস সংখ্যা, ১৯৮১-সালে,প্রকাশিত জিল্লুর রহিম রচিত ‘ঢাকা শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সকল অভিযান শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে সংকলিত)

 

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে অর্থাৎ মে মাসের শেষের দিকে আগরতলার এক ক্যাম্পে আমাদের ‘কমান্ডো’ আক্রমণের কলাকৌশল সম্পর্কে ক্লাশ নিচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন হায়দার (পরবর্তকালে কর্নেল) ক্লাশ চলাকালে ক্যাম্প পরিদর্শনে এলেন ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ (পরবর্তীকালে ব্রিগেডিয়ার)। সেখানে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবলকে দৃঢ় করার জন্য সংক্ষিপ্ত এক জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। এরপর তিনি একটি “সুইসাইড স্কোয়াড” গঠন করেন। সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। এই স্কোয়াড পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য ছিলো ঢাকা শহরে দখলদার সামরিক বাহিনীর আতঙ্ক সৃষ্টি করা, সেই সঙ্গে বিদেশী সাংবাদিক এবং বিদেশী অর্থনীতিক সাহায্যদাতা সংস্থার লোকজনের মধ্যে এই ধারনা দেয় যে, ঢাকা শহরের কেন্দ্রবিন্দুতেও মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা ও আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে।

 

জুনের প্রথমে আমাদের ১৬ জনের দলটি ঢাকার দিকে রওনা দেয়। আমাদের এই ১৬ জনের কাছে জনপ্রতি ৪টি করে গ্রেনেড এবং ২০ পাউণ্ড করে বিস্ফোরক ছাড়া অন্য কোন অস্ত্র ছিল না। ঢাকা আসার পথে দলের ৪ জন স্বেচ্ছায় বিচ্ছিন্ন হয়ে ফিরে যান। ৬ই জুন আমরা ঢাকা শহরে প্রবেশ করি। ঢাকায় এসে আমরা জানতে পারলাম যে ৯ই জুন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সামরিক জান্তা এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। প্রিন্স সদরুদ্দিনসহ অর্থনৈতিক সাহায্যদাতা সংস্থার বেশকিছু প্রতিনিধি এবং বিদেশী সাংবাদিক এসেছিলেন। তারা হোটেল ইন্টারকনে ছিলেন। সামরিক জান্তা তাদের ভেতর প্রচার করেছিল যে ঢাকা শহর সম্পূর্ণ শান্ত। দেশের কোথাও মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে না, শুধু সীমান্ত এলাকায় সামান্য গোলমাল ছাড়া। আমরা সেই ধারনা পাল্টানোর জন্য প্রথমে ইন্টারকনে অপারেশন করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করি। অপারেশনের দিন ঠিক করা হয় ৯জুন। কারণ, ঐদিন রাত ৭-৩০ মিনিটে বিদেশী সাংবাদিক ও সাহায্যদাতা সংস্থার প্রতিনিধিদের সন্মানে সামরিক জান্তা নৈশভোজের আয়োজন করে।

 

অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে অপারেশন করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে প্রথমে আমরা ইন্টারক্নে ‘রেকি’ করি। আমরা সব সময় ‘রেকির’ উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতাম। কারণ, অভিযানের সাফল্য শতকরা ৯০ ভাগ নির্ভর করে সঠিক ‘রেকি’র উপর। রেকিতে আমার সঙ্গে ছিলো আলম ও জিয়া। রেকি করার দিন বিকেলবেলা একটি গাড়িতে করে স্বাভাবিক ভাঙ্গিতেই আমরা হোটেলের সামনে নেমে ভিতরে যাই। প্রথমে আমাদের কাজ ছিল অপারেশনটা কিভাবে পরিচালনা করা যায় সে সম্পর্কে হোটেলের ভেতরে অবস্থান সম্পর্কে সঠিক ধারনা নেয়া। সিদ্ধান্ত মোতাবেক রেষ্টুরেন্টে যাই এবং কিছু খাওয়া-দাওয়ার ছলে আমাদের প্রয়োজনীয় সময় ব্যায় করে ভেতরের সকল অবস্থান সম্পর্কে ওয়াকেবহাল হয়ে ফিরে আসি। শেল্টারব ফিরে আমরা দলগতভাবে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে পর্যালোচনা করার পর আক্রমনের কৌশল নির্ধারণ করি। আমরা শুধুমাত্র গ্রেনেড ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য ৬ জনের একটি দল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। অপারেশনের জন্য একান্তভাবে গাড়ির প্রয়োজন, কিন্তু আমাদের কোন গাড়ির ব্যবস্থা ছিল না।

 

ইন্টারকনে যেদিন অপারেশন করেছিলাম সেইদিন সন্ধ্যা আনুমানিক ৬-৩০ মিনিটের পর গুলশান থেকে একজন আবাঙালির একটি গাড়ি জোড়পূর্বক সংগ্রহ করা হয়। ঐ গাড়িতেই ৬ জনের ‘অপারেশন গ্রুপ’ নিয়ে আমরা রওনা হই। বাদল মামা গাড়ি চালাচ্ছিলেন। গাড়ির সামনের সিটে ছিলেন চুলু ভাই ও স্বপন। পেছনে আমি জিয়া ও আলম। হোটেলের সামনের দিকে গাড়ি থামিয়ে আমরা তিনজন নেমে পড়লাম। তখন ইন্টারকনে সামনের দিকটায় উঁচু কয়েকটি গাছ ছিল। গাড়ি থেকে নেমে সামনের দেয়াল টপকে আমরা ভিতরে প্রবেশ করে আবছা অন্ধকারে গাছের আড়ালে চলে যাই। ঘড়ির কাঁটার সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের সময় অতিবাহিত হচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্তে আমরা তীক্ষ্ণতার সঙ্গে লক্ষ্য করে হোটেলের মূল প্রবেশ পথে পরপর তিনটি গ্রেনেড ছুড়ে ফেলি। গ্রেনেড গুলো বিস্ফোরিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা গাছের আড়ালেই দাঁড়িয়ে থাকি। ইতিমধ্যে বিস্ফোরণের শব্দে লোকজন ছুটোছুটি, চিৎকার শুরু হয়েছে। আমরা দেয়াল টপকিয়ে তড়িৎ গতিতে গাড়িতে উঠে পড়ি।

 

আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গাড়ি ঘুরিয়ে আমরা চলে যাই রমনা থানার কাছে জনৈক জামাত নেতার বাড়িতে। সেখানে তখন হানাদার বাহিনীর তাবেদার শান্তি কমিটির লোকজনের এক সম্মেলন চলছিলো। আকস্মিকভাবে আমরা গাড়ি নিয়েই ভেতরে ঢুকে পড়ে পরপর তিনটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে চোখের নিমিষে গাড়ি ঘুরিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাই। সেদিন আমাদের সিদ্ধান্ত ছিলো ইন্টারকনে অপারেশন সফল হলে ঢাকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আক্রমন করা। তাই রমনা থেকে সোজা চলে যাই ‘দৈনিক পাকিস্তান’ (দৈনিক বাংলা) ও ‘মর্নিং নিউজ’ সংবাদ-পত্র অফিসের সামনে। চলন্ত অবস্থায় সেখানে ২ টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে আমরা পুরানা পল্টনের গলিতে ঢুকে পড়ে সেখানে গাড়ি ফেলে নিরাপদে ফিরে যাই।

 

ঢাকা শহরে একই দিনে আমরা এই তিনটি সফল আক্রমন পরিচালনা করেছিলাম। সেদিনের ঘটনা আজো আমার স্মৃতিতে ভাসে, কারণ, এই আক্রমণ ছিলো ঢাকা শহরের প্রথম সফল গেরিলা অভিযান।

Scroll to Top