সাক্ষাৎকারঃ মেজর মাহফুজুর রহমান

<১০, ., ৬২৬৮>

অনুবাদ 

১নং সেক্টরের যুদ্ধ বর্ননা

(সাক্ষাৎকারঃ মেজর মাহফুজুর রহমান, বীর বিক্রম, ২৫ আগস্ট, ১৯৭৩)

 

৩ মে ১৯৭১ এ, হরিনা নামক স্থানে আমাদের জন্য একটি নতুন ক্যাম্প নির্বাচন করা হয়,যেটি ছিল ছিল সাবরুম থেকে ৫ মাইল দূরে। মেজর জিয়াউর রহমান (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার), মেজর শওকত আলী (বর্তমানে কর্নেল), মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) রফিক, ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) খালেক,ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) অলি, ক্যাপ্টেন(বর্তমানে মেজর) এনামুল হক, আমি, জনাব ইসহাক (এডমিনস্ট্রেশান অফিসার), জনাব মুরে (এমটিও),অসংখ্য এমসিএ সেখানে ছিল। পরবর্তীতে আরও অসংখ্য অফিসার,যেমন- স্কোয়াড্রন লিডার(বর্তমানে কর্নেল) শামসুল হক,মেজর(বর্তমানে লেফট্যানেন্ট কর্নেল) খুরশিদ, ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট(বর্তমানে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান, ক্যাপ্টেন(বর্তমানে মেজর) মতিউর রহমান,ক্যাপ্টেন শামস (গত), ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট আবদুর রউফ, ফ্লাইং অফিসার শওকত সহ আরো অনেকে। এই স্থানটি হয়ে উঠে ১ নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার এবং এর নেতৃত্বে ছিলেন মেজর(বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) রফিকুল ইসলাম।

 

এলাকাটি চিনতে ও এর সাথে লাগোয়া সীমানা পর্যবেক্ষনে এবং লোক নিয়োগে কিছুদিন সময় লাগে। কয়েকজন বিশ্বস্ত কর্মকর্তা আমাদের সেক্টরের হেডকোয়ার্টারে আসেন এবং আমাদের কিছু মাইন,এক্সপ্লোসিভস ইত্যাদি দেখান। ১০ মে মেজর (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) জিয়াউর রহমান আমাকে আলীনগর বিএসএফ ঘাটিতে নিয়ে যান এবং সেখানে ক্যাপ্টেন পিকে ঘোষ (আলী) এর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। যিনি ছিলেন ওই ঘাটির কমান্ডার এবং আমাদের সৈন্যদের সাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনেক অপারেশনের সাথে ছিলেন। আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে। পরদিন সকালে আমি তার সাথে শুভপুর ব্রিজে যাই এবং  দেখতে পাই আমাদের সৈন্যরা তাদের শেষ চেষ্টা দিয়ে এটি দখলে রাখছে। আমি আমার কাজ পেয়ে যাই,যার কারনে আমার এখানে আসা। এবং সেটি হল যেকোন মূল্যে মুহুরিক রেল ব্রিজটি উড়িয়ে দিতে হবে।  ১১ এপ্রিল রাত ১২ টার দিকে দুইজন পিএলেস সুবেদার সাবেদ আলী ও সুবেদার জালাল আহমেদের অধীনে ব্রিজের দিকে রওনা হই। আমার দলের সাহসী ইঞ্জিনিয়ার এনসিও জুলফিকার আলী ছিল আমার ডিমোলিটার। আমাদের অনুগত কিছু বাহিনী এর আগেও ব্রিজটি ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু দিনের বেলায় এটি সর্বক্ষন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাতের বেলায় রাজাকার ও তাদের সহযোগী বাহিনীর পাহাড়ায় থাকে। ফলে সবগুলো প্রয়াসই ব্যার্থ হয়েছিল। যাই হোক, পথিমধ্যে আমি কয়েকজন নিশস্ত্র সেন্ট্রি পাই যাদেরকে গ্রেফতার করে সাথে নিয়ে চলি আমাদের এক্সপ্লোসিভ বক্স গুলো বহন করার জন্য। ভোর প্রায় চারটার দিকে,যখন চাদের আলো প্রায় শেষ হয়ে আসছিল আমরা অনেক বাঁধা পেরিয়ে ব্রিজের কাছে চলে আসতে সক্ষম হই। প্রায় ১০-১৫ জন সাধারন নাগরিককে হাঁটাচলা ও গল্পগুজব করতে দেখতে পাই। পাকিস্তানি সেনা আছে কিনা তা বোঝার জন্য কয়েক মিনিট পর্যবেক্ষন করি। তারপর আর সময়ক্ষেপন না করে সরাসরি আমার কাজে নেমে পড়ি। কিন্ত প্রায় দশ মিনিটের মাথায় প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ জন স্থানীয় লোক ব্রিজের পাশে জড়ো হয় এবং চিৎকার করে আমাদের ব্রিজ উড়িয়ে দিতে বাঁধা দেয়। এমনকি তাদের মধ্যে অনেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে খবর দেয়ার ভয় দেখায়। এই চিৎকার গন্ডগোলের মাঝেও প্রায় ২০-২৫ মিনিট লেগে যায় ব্রিজের দুই পাশে এক্সপ্লোসিভগুলো ফিট করতে। তারপর আমি আমার প্লাটুনকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে বলি এবং স্থানীয়দের এই মুহূর্তে স্থান ত্যাগ করতে বলি। কিন্ত বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও তারা আমার কথার কোন গুরুত্বই দেয় না। তারপর আমি সেফটি ফিউজ ফায়ার টি চালু করে দেড় মিনিট পর্যন্ত দৌড়ে দূরে চলে আসি। কানফাটা শব্দে ব্রিজের একপাশ ধসে পড়ে। পরবর্তীতে আমি আমার প্লাটুনের সাথে যোগ দেই এবং ক্যাম্প ত্যাগ করি। এই সকালেই শুভপুর ব্রিজে আক্রমন হয় এবং সেটি দখল করা  হয়।

 

জুনে মেজর (বর্তমানে বিগ্রেডিয়ার) জিয়াউর রহমান বেঙ্গল রেজিমেন্ট ৮ E এর মূলভাগ এবং সেইসাথে সেক্টর ১ এর আরো কিছু বিচ্ছিন্ন ফোর্স মিলিয়ে তুরাতে একটি পরিপূর্ন নূতন ব্যাটেলিয়ন প্রস্তুত করেন। ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন সাদেক, ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন এজাজ ছিলেন এই ফোর্সের সাথে। আমাকে ১ নাম্বার সেক্টর সাথে সাবরুমে ৩ নাম্বার সাবসেক্টর এর কমান্ডার করা হয়। ১ নাম্বার সাবসেক্টর টি ছিল বিলোনিয়ায় ক্যাপ্টেন শামস (গত) এর অধীনে। দুই নাম্বার সাবসেক্টর টি ছিল ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর)  মতিউর রহমান এর অধীনে যা অবস্থিত ছিল শোভাপুরের নিকট শ্রী-নগরে। তিন নাম্বারটি ছিল আমার অধীনে এবং এর অবস্থান ছিল রামগড়ের ঠিক বিপরীতে। চার নাম্বার সাবসেক্ট্ররটি ছিল ইপিআর সুবেদার খায়রুজ্জামানের অধীনে এবং যায়গাটির নাম ছিল তবলছড়ি, কাসালং এর উত্তরে। মেজর (বর্তমানে কর্নেল) শওকত সিলেটে পাচ নাম্বার সেক্টরের কমান্ড গ্রহন করেন। ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) এবং এডজুডেন্ট ফ্লাইট ল্যাফটেনেন্ট  (বর্তমানে স্কোয়াড্রন লিডার) সুলতান আহমেদ ছিলেন ইনডাকটিং অফিসার।

 

আমি আমার সাব সেক্টরের অধীনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন যায়গায় অপারেশান পরিচালনা করছিলাম যেমন রামগড়,চিকনাছড়া,হাইকু, নারায়নহাট,কারিরহাট,শুভপুর, জোরারগঞ্জ,মাস্তান নগর এবং মীরসরাই এর অধিকাংশ যায়গা যা ছিল বর্ডার এর ২০ মাইলের মধ্যে। গত ২-৩ মাসে আমার সাব সেক্টরের সেনারা কয়েকটি সফল অভিযানের মাধ্যমে শত্রুদের মাঝে ত্রাসের সৃষ্টি করে। গত তিন মাসে বিভিন্ন অপারেশনে হতাহতের সংখ্যা ছিল ৩০০ এর বেশী। আমার সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক এবং পুরো সেক্টরের দোয়া আমাদের উপর ছিল কারন আমরা পরিপূর্ন সন্তুষ্টি সহকারে অপারেশন গুলো সম্পন্ন করতে পেরেছিলাম। বিগ্রেডিয়ার আনন্দ স্বরুপ পরবর্তীতে ১ নাম্বার সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহন করেন এবং ২৮ আগস্ট ১৯৭১ সালে প্রথমবারের জন্য আমার সাবসেক্টর টি পরিদর্শন করেন এবং আমাদের অনুপ্রেরণা যোগান।

 

পরবর্তীতে আমাকে শ্রীনগরে ২ নাম্বার সাব সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহন করতে বলা হয় যা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ন একটি স্থান। একাত্তরের ১৫ সেপ্টেম্বর,আমি আমার কিছু সাহসী পুরানো যোদ্ধা বন্ধু যেমন ক্যাপ্টেন পিকে ঘোষ,লেফট্যানেন্ট কর্নেল হিম্মত সিং সিও ৪ গার্ডস,ক্যাপ্টেন বাজওয়া একমাত্র আর্টিলারি অফিসারদের সাথে মিলিত হই। তারা সকলেই আমাকে সেখানে পেয়ে আনন্দিত ছিলেন। জনাব খায়রুদ্দিন এমসিএ-ইয়ুথ ক্যাম্প কমান্ডার এবং আফসারুদ্দিন ব্যারিস্টার, আরেকজন ক্যাম্প কমান্ডার (ব্ল্যাক শার্ট) আমার সাথে ক্যাম্পে দেখা করেন এবং আমার সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করেন। পরবর্তীতে আমরা ৪ টি দলের একটি অপারেশান চালনা করি পাকিস্তানি একটি ক্যাম্পে,  চম্পকনগরে। যেখানে লেফন্যানেন্ট কর্নেল হিম্মত সিং নিজে আমার সাথে ছিলেন।

 

১৯ সেপ্টেমবর ১৯৭১  এ চারজন গার্ড স্থানান্তরিত করা হয় ১৪ রাজ রিফ, লেফট্যানেন্ট কর্নেল ওম প্রকাশ শর্মা বল্লভপুর ও চম্পকনগরে অপারেশানের জন্য একটি প্ল্যান তৈরী করেন। রাতের বেলার এই আক্রমনের জন্য দিনের বেলা রিহার্সেল করা হয়। ২১ সেপ্টেম্বর ভোর ৩ টা ত্রিশ মিনিটে দুইটি গ্রুপে ভাগ হয়ে সৈন্য রওনা হয়। যার একটি ছিল লেফট্যানেন্ট আবদুল হামিদের নেতৃত্বে বল্লভপুরে এবং আরেকটি ছিল আমার অধীনে চম্পকনগরে। আমরা একই সময়ে আক্রমন শুরু করি। আমাদের শেলিং আক্রমন ছিল ভয়াবহ যদিও তারাও খুব সহজ ছিল না। যদিও আমরা দ্রুত টার্গেট নিয়ন্ত্রনে আনতে পারি নি। আমাদের সকল শেল ই টার্গেটের আশেপাশে পড়ছিল এবং তারা প্রাণভয়ে পালাতে শুরু করে। আমরা তাদের বন্দি করতে ব্যর্থ হই। আমার একজন সিপাহী আহত হয় এবং রাজ গ্রুপের দুইজন সিপাহি আহত হয়।

 

৫ অক্টোবরে জনাব সামাদ,বাঙ্গলাদেশের এক্টিং ডিফেন্স সেক্রেটারি,জেনারেল সরকার, এবং বিগ্রেডিয়ার শাহ আমার ক্যাম্প পরিদর্শন করেন এবং চলমান অবস্থার পরিপূর্ন একটি রিপোর্ট দেখতে চান। গত কয়েক দিনে অসংখ্য ব্রীজ, বিদ্যুতের পাইলন ধ্বংস করা হয়। অসংখ্য সফল এমবুশ,রেইড, এসাল্ট চালনা করা হয়। এবং পরবর্তীতে আরো সহযোগী কিছু সংগঠন বল্লভপুর,মধুগ্রাম,শ্রী নগর এবং ছাগলনাইয়ার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে দূরে সরে আসতে শুরু করে।

 

আমার একটি প্লাটুন পুলিশের সুবেদার রাফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ছিল। তাকে কিছুদিন আগে আমি এফ এফ এর কিছু দল সহ বাংলাদেশের ভিতরে মিরেরসরাইতে পাঠাই। সেখানে সে ২ সপ্তাহ ছিল। প্রচুর সফল অপারেশন করে। এবং একদা এক পাকিস্তানী মেজরের কাটা মাথা নিয়ে হাজির হয়। ঐ অপারেশনগুলোতে আমাদের একজন সাহসী শিক্ষানবিশ এফ এফ নিহত হয়। নায়েক জুলফিকারের বাম কাঁধ উড়ে যায়। বেঙ্গল ৮ ই এর সিপাহি নুরুল আলমের পেট ও থাই এর পিছনের দিকটা উড়ে গেলেও অনেক কষ্টে সে নিরাপদে ফিরে আসে।

 

১৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ভাই, কিছু ভিআইপি, জেনারেল নরেন্দর সিং, মেজর (বর্তমানে লে কর্নেল) নুরুল ইসলাম এবং আরও ৪০ জন অফিসার আমার ক্যাম্পে আসেন এবং আমার সৈন্যদের বাহবা দেন।

 

উত্তরে নালুয়া বিওপি পর্যন্ত আমার প্রতিরক্ষ বাড়াই। সেখানে চাঁদগাজির বেলনিয়া ও আলমিহাঁট পর্যন্ত অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন সাহসী ইপিআর এর জে সি ও সুবেদার লনই মিয়া। দক্ষিণে কারেরহাঁট – শোভাপুর  পর্যন্ত আরেকজন সাহসীর দায়িত্বে ছিল। তিনি হলেন ই পি আর এর জেসি ও এন/সুবেদার রহমত আলি। আরও কিছু সাহসী জে সি ও  ইপি আর এর এক্টিং সুব মেজর ফখরুদ্দিন, ৮ ই বেঙ্গলের সুবেদার সাবেদ আলি, ই পি আর এর সুবেদার আব্দুল গনি যারা কয়েক মাস ধরে প্রচুর সফল অপারেশন চালিয়েছেন এবং সুনাম কুড়িয়েছেন।

 

২১ শে অক্টোবর আমার তিন প্লাটুন বাংলাদেশের ভিতরে ধুঁকে পরে তিনটি ভিন্ন জায়গায় যথাক্রমে ফটিকছড়ি, নাজির হাঁট ও মীর সরাই এ স্বাধীন হবার শেষ দিন পর্যন্ত অপারেশন চালায়। একটি ছিল সুবেদার সাবেদ আলি -লে শওকতের অধীন। দ্বিতীয় টি এনআই সুবেদার রহমান এ ইউ লে ফারুক আহমেদের সাথে, আর তৃতীয়টি সুবেদার রফিকুল ইসলাম লে রকিবের সাথে।

 

২৪শে অক্টোবর আমার এলাকায় একটি সম্মেলন হয়। ব্রিগেডিয়ার সান্ধু কমান্ডার ৮৩ বিডীই, লে কর্নেল বিশলা সি ও ৮ বিহার, লে কর্নেল ভিড়ক কমান্ডার আর্টিলারি, মেজর বাজওয়া সমরগঞ্জের বিওপি কমান্ডার এবং আমি সেখানে ছিলাম। এর পড় আমরা সবাই বেলনিয়া বিওপি পর্যন্ত রেকু করি। কিছুদিনের ভেতর আমি আমার সাব সেক্টরের বাহিনীর তিন চতুর্থাংশ নিয়ে বেলনিয়ার কাছে চলে যাই। ৩০ অক্টোবর শান্তিরহাট এ ৮৩ বিডিই হেডকোয়ার্টারে সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকের সাথে মিটিং করি। পরবর্তি অপারেশনের জন্য বাহিনীকে সতর্কতা আদেশ প্রদান করি। গুথুমা ও মোতাই বিওপি তে রেকু করি। ১ নভেম্বর ৩য় কনফারেন্সে অংশ নেই। লে জেনারেল সাগাত সিং ও মেজর জেনারেল হিরা সেখানে ছিলেন – তাদের সাথে বেলনিয়াতে প্রবেশের নিয়মিত  আলোচনা করি।

 

বেলনিয়ার ৪ মাইল দক্ষিণে পরশুরামের নিকট রাস্তা ব্লক করার দায়িত্ব আমরা ৮৩ বিডিই এর কাছে থেকে পাই। এর উদ্যেশ্য ছিল আমাদের দক্ষিণ থেকে আক্রমণ ঠেকানো। মহুরি নদী বেলনিয়ার ভিতর সোজাসুজি উত্তর দক্ষিণ বরাবর গিয়ে এটিকে পূর্ব ও পশ্চিম দুই সেক্টরে বিভক্ত করেছে। পূর্ব দিকের ১ নং সেক্টরের কমান্ডার আমাকে বানানো হল। আর পশ্চিমের দায়িত্ব দেয়া হল ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) জাফর ইমামকে।  ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের সাথে ক্যাপ্টেন হেলাল মুশেদের নেতৃত্বে ১০ ই বেঙ্গল ও ২ ই বেঙ্গলের একটি দল মোতায়েন ছিল। আমার ৪ টি দল ছিল। বেশিরভাগ ইপিআর এর  ছেলেরা। লে মন্সুরুল আমিনের নেতৃত্বে ২টি দল ও আমার সাথে ২ টি। লে মন্সুরের ৬ পিআই কমান্ডার ছিল ই পি আর এর সুবেদার আজিজ, ই বেঙ্গলের হাবিলদার (বর্তমানে এন/সুবেদার) ইমাম,  পুলিশের হাবিলদার (বর্তমানে এন/সুবেদার) এরশাদ। আমার সাথে ৬ জন ছিল। সুবেদার লনি মিয়া ই পি আর থেকে, এক্টিং সুবেদার মেজর ফখরুদ্দিন ই পি আর থেকে, সুবেদার আব্দুল গনি ই পি আর থেকে, হাবিলদার শহীদ ই পি আর থেকে, এন/সুবেদার নুরুজ্জামান ই পি আর এর এবং এন/সুবেদার দিন মোহাম্মাদ ই পি আর থেকে। লে মন্সুরের সাথে ৩’’ মর্টার ছিল ই পি আরের এন/সুবেদার মানিকের কাছে। আমার কাছে ৩’’ মর্টার টি ই বেঙ্গলে এন/সুবেদার সাইদ আহমেদের কাছে ছিল। আমার সেক্টরে ২ টি রাজপুট যুক্ত ছিল এবং ক্যাপ্টেন জাফরের সেক্টরে ছিল দগড়া।

 

৩/৪ নভেম্বর রাতে আমরা বেলনিয়াতে রেকু করি। ৬টি রোড ব্লক পজিশন ছিল আমার অধীনে আর ৬ টি ছিল ক্যাপ্টেন শামসের অধীনে। আশ্চর্যের বিষয় ছিল বর্ডারের ৫ মাইলের ভিতর রেকু করলেও আমাদের উপর কোন আক্রমণ আসল না। ১ নং সেক্টরের উপ অধিনায়ক ক্যাপ্টেন শামস এই দিন সন্ধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন। সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক ও বেলনিয়ার মেজর প্রধান তাকে দেখতে আসেন। বেলনিয়ার বাংলাদেশের অংশে তাকে দাফন করা হয়। লে মন্সুর এই সেক্টরের উপ অধিনায়ক নির্বাচিত হন।

 

৫ নভেম্বর ৫টা ৩০ মিনিটে আমরা বেলনিয়াতে প্রবেশ করি। আমাদের রোড ব্লকের শেষ পয়েন্ট ছিল সালিয়া দীঘি, পরশুরাম পি এস এর ২ মাইল দক্ষিণে, বর্ডারের ৫ মাইল ভিতরে বেলনিয়া ছাগল নাইয়া মেইন রোডের পাশে। ২ রাজপুতের একটি প্লাটুন ও আর্টিলারি ও পি আমার সাথে ছিল। তখন ছিল গভীর রাত এবং মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল যখন আমরা সেখানে প্রবেশ শুরু করি। রাস্তা পিচ্ছিল ছিল, অন্ধকারে একে ওপরকে হারিয়ে ফেলছিলাম, অনেকে ঠাণ্ডায় কাপাকাপি করছিলাম। রাত ১২ টার সময় আমরা গন্তব্যে পৌছালাম। তখন প্রচণ্ড ঝড় হচ্ছিল। আমরা অবস্থা নিতে শুরু করি এবং এখানে সেখানে গর্ত করতে থাকি। ঝরের কারণে আমাদের এফ এফ রা তাদের জি সি আই শিট আমাদের পচনে আনতে পারছিলনা। আসে পাশে যা কিছু ছিল তাই দিয়ে আমরা মোটামুটি একটা ডিফেন্স বানালাম।

 

পরের দিন ৬ নভেম্বর ৫ টা ৩০ মিনিটে গুথুমা বিও পি তে একটি পেট্রোল সম্ভবত রেকু করে ফিরছিল। তখন তারা সুবেদার লনি মিয়া পি আই এর আক্রমণে পড়ে শেষ হয়। ১০ টার দিকে শত্রুরা আমাদের ব্যাপারে জানতে পারে এবং চারদিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। ঝরের ভিতর সারা দিন তারা আমাদের পরাস্ত করতে চেষ্টা করেও ব্যার্থ হয়। রাতে আমার লেফট ফরওয়ার্ড পি আই হাবিলদার শহীদ শত্রুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। কিন্তু শত্রুরা হতাহত হয় এবং তাদের লাশগুলো এলোমেলো ভাবে পড়ে ছিল।

 

৭ নভেম্বর ৪টা ৪৫ মিনিটে ১১ পাঞ্জাবের একটি দল আমার বামের হাবিলদার শহীদের অংশে আবার আক্রমণ করে। আক্রমণ করতে করতে তারা দলের মূল ঘাঁটি সালিয়া দীঘির কাছে পৌঁছে যায়। আমি বুঝিনি কি হয়েছে। আমি দেখছিলাম আমাদের ও শত্রুবাহিনী আমাদের দিকে দৌড়ে আসছে। শেষ পর্যন্ত শত্রুবাহিনী আমাদের ঘাঁটি পর্যন্ত আস্তে না পারলেও সালিয়া দীঘির পাশে আমাদের ঘাঁটি থিক ১০০ গজ দূরে আমাদের অবস্থানটি দখল করে নেয়। ৫ জন সেনা, ২ জন এফ এফ, পি আই কমান্ডার হাবিলদার শহীদ ধৃত হন এবং তাদের হত্যা করা হয়। ২ দিন ধরে ৭ টি লাশ সেখানে পড়ে ছিল। হাবিলদার শহীদ কে ফেনী জেলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাকে সেখানে গুলি করে হত্যা করা হয়। জেলে তার একজন ভাতিজা ছিল – সৌভাগ্যক্রমে স্বাধীনতার দিনটি পর্যন্ত সে জীবিত ছিল।

 

২ দিন ধরে আমি শত্রুদের থেকে আমার অবস্থান টি পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারা যাচ্ছিলনা। গত ২ দিন ধরে শত্রুরা আমাদের উপর অনেক আক্রমণ চালিয়েছে। সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল ৮ নভেম্বর সন্ধ্যায়। পরশুরাম ও বেলনিয়া আমাদের অপারেশনে আসল। এই মুহূর্তে আমরা ছিলাম পিছনে – শুরু দক্ষিণে শত্রুরা আমাদের সামনে ছিল।

 

৯ নভেম্বর এক্টিং সুবেদার মেজর ফখরুদ্দিন ও ২ রাজপুটের লে কুমুদের প্লাটুন দক্ষিণ বেড়াবাড়িয়া গ্রামে আমাদের পুরনো অবস্থান যেটি হাবিলদার শহীদের অধীনে ছিল সেটই পুনরুদ্ধার হয়। শত্রুরা তাদের বা আমাদের মৃতদেহ কনটিকেই মাটিচাপা দেয়নি। আমরা ১৫ টি পচা লাশ সেখানে পেয়েছিলাম যেগুলোকে মশা, মাছি আর পোকা ধরে গেছিল।  তাই একটি লাশ ও আমরা সনাক্ত করতে পারিনি। একটি লাশের পকেটে পবিত্র কুরান ছিল আর একটি কাগজে লেখা ছিল ‘২৪৮৪৫৪৭ সেপাই মুশ্তাক আহমেদ’। পালাবার সময়ে শত্রুপক্ষ প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ রেখে যায়। একটি ঝুরিতে লেখা ছিল ১১ পাঞ্জাব।

 

৯ নভেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টায় ৩টি শত্রু বিমান আমাদের অবস্থানের ওপর নাপাম বোমা বর্ষন করে। আমার একজন সেপাহি আহত হয়েছে। আর মেজর শহীদের দলের একজন আহত হয় এবং ঘটনাস্থলেই মারা যায়। ১০ নভেম্বর শত্রু পক্ষ চাতালিয়া ও কাপ্তান বাজার থেকে আক্রমণ চালায়। কিন্তু আমাদের অবস্থান থেকে আমাদের সরাতে ব্যার্থ হয়। আজ বিকেল সাড়ে ৩ টায় ৪টি বিমান দিয়ে আবারো আক্রমণ করে। সন্ধ্যায় চাতালিয়ায় ডান দিক থেকে একটি ব্যাটালিয়ন আক্রমণ করে। তাছাড়া সামনে সাতকুচিয়া আর বামে গুথুমা থেকেও আক্রমণ করে কিন্তু ব্যার্থ হয়। সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের সাথে ছিলেন। শত্রুদের প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি হয় এবং তারা ২/৩ মাইল পিছু হটে। পরেরদিন সকালে PAF CESNA আমাদের উপর দিয়ে ঘোরা শুরু করল এবং গোলা নিক্ষেপ শুকু করে। ১২ নভেম্বর শত্রু সেনারা গুথুমা ত্যাগ করে। ২ রাজপুট এর লে কর্নেল দত্ত ও সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক আমাদের সাথে দেখা করলেন এবং বাহবা দিলেন। সালিয়া দীঘি থেকে আমি আমার বাহিনী নিয়ে এসে ১ মাইল দূরে আরও ভালো অবস্থান নিয়ে নিলাম।

 

বেলনিয়া হেডকোয়ার্টারে সকল অপি কমান্ডারদের নিয়ে একটি কনফারেন্সের আয়োজন করা হল। ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) জাফর ইমাম সেখানে ছিলেন। সফল যুক্ত অপারেশনের জন্য আমরা একে ওপরকে জড়িয়ে ধরলাম। মেজর জেনারেল হিরা আমাদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিলেন এবং আমাদের বাহবা দিলেন। আমাদেরকে আমাদের বর্তমান লাইন বেলনিয়া- ছাগল নাইয়া থেকে আরও এগিয়ে যাবার আদেশ দেয়া হল। আমরা আরও ২ মাইল এগিয়ে গেলাম। মোতাইখালের কাছে। আমাদের ডানে কেত্রাঙ্গা তে আর বামে বাঘমারা আর সামনে কাপ্তান বাজারে শত্রুদের শক্ত ঘাঁটি ছিল।

 

১৯ নভেম্বর বিডি ইহেড কোয়ার্টারে আরেকটি মিটিং করি। এখন আমরা একটি নতুন ১৮১ বিডিই এর অধীনে আসলাম সেটাতে দায়িত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আনন্দ সরূপ। লে কর্নেল হাসাবনিসের দায়িত্বে একটি নতুন ব্যাটালিয়ন ৬ জাত আমার বাহিনীতে যুক্ত হয়।  আমার বাহিনী ও ৬ জাত নিয়ে বেলনিয়ার ৯ মাইল দূরে আমরা আমাদের ২ য় রোড ব্লক শুরু করি খেজুরিয়া বিওপি এর ভিতরে মহাম্মাদপুরের দক্ষিণে। শত্রুরা আমাদের বিপক্ষে ফিল্ড আর্টিলারি ব্যাবহার করছিল। জগতপুর গ্রামে শত্রু অবস্থানে আক্রমণ করি। ১০ রাজাকার ও ১৫ বালুশ আমাদের কাছে আত্তসমর্পন করে। সেই অপারেশনে ৬ যাতের একজন নায়েক নিহত হয়। চিতলিয়া, কাপ্তান বাজার, মহাম্মাদপুর, খেজুরিয়ার বেশীর ভাগ অপারেশনে আমরা সবাইকে আত্তসমর্পনে বাধ্য করি। Allied PT. 76 amphibious tks were used in our support on 24th November. আমজাদঘাঁট ও চাঁদগাজি বাজারে শত্রুপক্ষ শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। আমরা আমাদের গতি ধরে রাখি। ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত। এটি মৃধার বাজার পর্যন্ত। ছাগল নাইয়াতে আব্দুল কাদের মজুমদার নামে একজন খুব ভালো বেসামরিক ব্যাক্তি আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেন। তিনি আমাদের সাথে যুদ্ধেও অংশ গ্রহণ করেন। গঙ্গাধড়বাজার, রেজুমিয়া ও ফেনী থেকে শত্রুরা পালিয়ে যেতে শুরু করে।

 

২৮ নভেম্বর শান্তির বাজার ১৮১ বিডিই হেড কোয়ার্টারে ব্রিগেডিয়ার আনন্দ সরূপের সাথে আরেকটি মিটিং করি। সেখানে সিও৬ যাত, সি ও ১৪ কুমাওন, সি ও ৩২ মোহর এবং আমাদের পরবর্তি কাজ বুঝিয়ে দেয়া হয়। এবারে আমাকে একটু বড় ও ঝুঁকি পূর্ন এলাকার দায়িত্ব দেয়া হল। আমার একটি প্লাটুন ছিল সুবেদার লনি মিয়াঁর নেতৃত্বে। তাদেরকে মাতুয়া গ্রামে অবস্থান নিতে বলা হল। এটি ছিল দখিন যশপুরে অবস্থিত শত্রুদের হেডকোয়ার্টারের নাকের ডগায়। তাই আমাদের এই প্লাটুনটিকে শত্রুরা সহজেই আক্রমণ শুরু করে। শত্রুরা একটি স্টিম রোলার এনে আমাদের ঐ এলাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে থাকে।

 

কিন্তু আমরা সেটিকে ট্যাঙ্ক ভাবতে থাকি। কিন্তু স্থানীয়দের কাছে জানতে পারি এটি একটি রোড রোলার মাত্র। অনেকবার অনুরোধ করার পড় ব্রিগেডিয়ার আনন্দ সরুম আমাকে কিছু ফোর্স দিলেন। মেজর গুরুং এর বাহিনী থেকে গুরখা পি আই এর ৩২ মাহার আমাদের দেয়া হয়। সাথে সাথে সেটাকে আমি সুবেদার লনি মিয়াঁর পি আই এ যুক্ত করি। মাইন, পেট্রোল ও গোলাগুলির কারণে আমি প্রতিটি অবস্থানেই দেখতে যাই। তবে ঐ সময়ে মুভ করা কঠিন ছিল। কারণ সর্বত্রই শত্রু পক্ষের মাইন পোঁতা ছিল। এগুলোর সব গুলোকে নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব ছিলোনা। ৩২ মাহারের এক নায়েক ৫৭ আর সি এল আনার সময় মাইনে পারা দেয় এবং তার ডান পায়ের কনুই থেকে হাঁটু পর্যন্ত উড়ে যায়। আমি আমার আর এম ও চট্টগ্রাম মেডিকেলের ৫ ম বর্ষের ছাত্র ডা শফিকুর রহমান ভুঁইয়া কে নিয়ে সেখানে যাই এবং প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে এ ডি এস মৃধার বাজারে পাঠানো হয়। এর কিছুক্ষণ পরই সুবেদার ফখরুদ্দিনের পি আই মাইনে আঘাত পান। ড্রেসিং করার মত একটি টুকরাও আমাদের কাছে ছিলোনা। একটি কম্বল দিয়ে ক্ষতটা পেঁচিয়ে তাকে ম্রিধার বাজারে পাঠানো হয়।

 

৩ ডিসেম্বর লে কর্নেল হর গোবিন্দ সিং ৩২ মোহরের সি ও তার ও জি পি আমার সাথে হেড কোয়ার্টারে দেখা করতে আসেন। তিনি শত্রুদের অবস্থানের একটি সম্পূর্ন ধারনা চাচ্ছিলেন। সেই রাতে তার গুর্খা পি আই যেটা আমার বাহিনীর সুবেদার পি ায় ফ্রন্টের সাথে যুক্ত ছিল তাদের অন্য একটি অপারেশনে যেতে বলা হয়। ফেরার সময় অকস্মাৎ একটি গুলিতে একজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। ছিরিঙ্গা দীঘিতে আমার বাহিনী ও মিত্র বাহিনীর মেজর গুরুং এর ৩২ মাহারের কিছু অংশ দিনব্যাপী আক্রমণ করে। ৫ ডিসেম্বর শত্রুরা প্রচুর মাইন রেখে পালিয়ে যায়। জায়গাটি সম্পূর্ন ক্লিয়ার করতে গেলে কয়েকজন বেসামরিক গাইড গুরুতর আহত হন।

 

সুবেদার মেজর মহিউদ্দিন নামে আমার একজন পিআই কমান্ড তার ডান পায়ে হাঁটুর নিচে গুলি খান। তাকে এ ডি এস মৃধাবাজারে পাঠানো হয়। এবং তার এম জি কমান্ডার এন/সুবেদার সফিউল্লাহ তার দায়িত্ব পান। ইতিমধ্যে আমাকে মুহুরি নদীর কাচজে রেজু মিয়া ব্রিজের নিকট পানুয়া (উত্তর) কাশীপুর ও নিজপানুয়া তে যেতে বলা হয়।

 

এখানে আমাকে বলা হয় আমার ডানে ৪ ই বেঙ্গল ফেনী থেকে চট্টগ্রামের দিকে আসছে আর ডানে বর্ডারের পাশ দিয়ে ৩২ মাহার আছে। আমরা ১৮১ বিডিইএর সাথে চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিলাম। এখন আমি আমার পুরনো জায়গায় আসলাম যেখানে আমি আগে বহু অপারেশন চালিয়েছি। ৬ ডিসেম্বর আমি আমার দল নিয়ে করিয়া বাজারে পৌঁছালাম। সেখানে ৪ ই বেঙ্গলের লে মুমতাজের সাথে দেখা হয় যার দল ধুম ঘাটের দিকে যাচ্ছিল। এখানে এতদিন পড় নিয়মিত ই বেঙ্গল ট্রুপ্স দেখে আমি খুশি হলাম।

 

প্রথন বারের মত ১ নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার বাংলাদেশের ভেতরে পরশুরামে স্থাপিত হল। ঢাক – চট্টগ্রাম রোডের লম্বা যাত্রা পথে সেক্টর কমান্ডার মেজর এনামুল হোক চৌধুরীর সাথে দেখা হয়। তিনি ৩২ মাহারের সাথে যাচ্ছিলেন। দেখা হল গঙ্গাধর বাজারের কাছে। পথে সর্বাপুর ও অন্যন্য গুরুত্তপূর্ন ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া হয়। নৌকায় জুরিন্দা দিয়ে ফেনী নদী পাড় হই। ৮ ডিসেম্বর মধ্য রাতে কারেরহাট পৌছাই।

 

৯ ডিসেম্বর সকালে আমাকে বলা হয় ৩২ মহার এর একটি দল মেজর ভাস্করের সাথে মেইন রোডে যেতে। ক্যাপ্টেন আলি নামে একজন আর্টিলাড়ি ও পি আমাদের সাঁথে ছিল। শত্রুরা ফেরার পথে আমাদের উপর বোমা বর্ষন করতে থাকে। যরাগঞ্জে পৌছাই ও আমার বাহিনী নিয়োগ করি। সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক ও যরাগঞ্জে এম সি এ মীর মশাররফ হোসেন এখানে আমাদের সাথে যোগ দেন এবং আমাদের উৎসাহিত করেন। এহন ৩ টি দল তিন দিক দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। আমি আমার বাহিনী নিয়ে সীতাকুণ্ডের দিকে, মেজর গুরুংফ তার দল নিয়ে ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড অক্ষে আর মেজর ভাস্কর রোডের ডান পাশ দিয়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে।

 

সারা রাত হেঁটে ৩ টা ৪৫ মিনিটে আমি আমার বাহিনী নিয়ে বারাইয়াধালা র‍্যালি স্টেশনে পৌছাই। এখানে আমি আমার পুরনো বাহিনীকে খুঁজে পাই যারা লে রকিব, ফারুক ও শওকাতের সাথে অনেক আগেই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। সেটা ছিল অক্টোবরে।  লে রকিব মীরের সরাইয়ে, লে ফারুক সীতাকুণ্ডে আর লে শাওকাত হাঁটহাজারিতে কাজ চালাচ্ছিলেন। আমি আমার পুরনো সাব সেক্টরের সবার সাথে দেখা হওয়ায় খুব অনন্দিত হলাম। লে শাওকাতের নাজিরহাটে কয়েকজন নিহত হওয়া ছাড়া বাকি সবাই অক্ষত আছে জেনে ভালো লাগলো।

 

সীতাকুণ্ডের প্রচুর শত্রু সৈন্য সমাবেশ হতে থাকল। এবার ব্রিগেডিয়ার আনাদ সরুম ৩২ মাহর কে একটি নতুন কাজ দিলেন। সীতাকুণ্ডের পিছন নিয়ে বাহিনী নিয়ে আমাকে যেতে বলা হল। মীর প্রকাশের অধীনে  ৩১ যাতের  একটি দলকে ভোর ৪ টার সময় রোড ব্লক করতে বলা হল – যাতে শত্রুরা পালিয়ে যেতে না পারে। লে কর্নেল হর গোবিন্দ সিং এর সাথে ৩২ মাহালের একটি দল ও মেজর গুরুং এর সাথে অন্য একটি দল সীতাকুণ্ড র‍্যালি স্টেশনে আক্রমণ করে। আক্রমণ রাতে করা হয়। এসময়ে অনেক সৈন্য অবস্থান ত্যাগ করেছিল। কিছু সৈন্য যারা আমাদের দিক দিয়ে পালানর চেষ্টা করছিল তাদেরকে আমরা আক্রমণ করি। কেউ নিহত হল, কেউ আত্ম সমর্পন করল। এখানে আমি লে মন্সুর ও লে ফারুক এর সাথে আবার দেখা হয়। তাদের সাথে আমি ৩ অক্ষে এগোতে থাকি। লে মন্সুর র‍্যালি লাইন, আমি ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড ও লে ফারুক ডানে উপকূলীয় এলাকা দিয়ে এগোতে থাকি।

 

১৫ ডিসেম্বর আমরা কুমিরাতে পৌছাই  এবং আমাদের সব সৈন্য সেখানে মোতায়েন করি। শত্রুরা আমাদের অবস্থানের উপর শেল নিক্ষেপ করছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে একটি শেল ক্যাপ্টেন আলির কাছে পরে। তিনি আমাদের আর্টিরালি ও পি – কিছুদিন ধরে আমাদের সাথে অপারেশন চালাচ্ছিলেন। তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। আমার প্রথম এলাইড আর্টিলারি ও পি হল ক্যাপ্টেন দারকুন্দে – বেলনিয়াতে। ক্যাপ্টেন আলি ছিলেন আমাদের ২ য় আর্টিলারি যে আমার সাথে থাকত, ঘুমাত, খেত, অপারেশন করত এবং আমাদের মাটিতেই নিহত হল।

 

১৬ ডিসেম্বর ৭১, ৮ বিহারের লে কর্নেল বিশলা – যিনি ছিলেন আমার নিকটের সাব সেক্টর প্রতিবেশী – আমাকে অনুরধ করলেন তাকে সাহায্য করার জন্য এইবার চট্টগ্রাম শহর আক্রমণের ব্যাপারে। তার এলাকা ছিল ফয়েজ লেক – যেটা ছিল বিহারিদের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা যেখানে শত শত নিরীহ বাঙ্গালীকে জবাই করে মারা হয়েছে। ৩২ মাহারের সি ও আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছিলেন না আর আমি আমার বাহিনীর সাথে মিশে গিয়েছিলাম। আমার সেক্টর কমান্ডারের অনুমতি ছাড়া আমি কাউকে সহায়তা করতে পারিনা। শত্রুরা তখনো এলোমেলো শেল নিক্ষেপ করে যাচ্ছিল। সর্বশেষ ভিক্টিম ছিলেন লে মন্সুরের বাহিনীর সুবেদার মাহফুজ ই পি আর। শেল পড়ার সাথে সাথে ঘটনাস্থলেই সে নিহত হয়। জেনারেল নিয়াজি তার বাহিনী নিয়ে আত্তসমর্পন করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হল।

 

এসডি / (মাহফুজুর রহমান)

৮ ই বেঙ্গল

২৫ আগস্ট, ১৯৭৩

Scroll to Top