সাক্ষাৎকারঃ মেজর দিদার আতাউর হোসেন

<১০, ৪.১২, ১৪৬-১৪৮>

সাক্ষাৎকারঃ মেজর দিদার আতাউর হোসেন

 

অক্টোবরে বাংলাদশ সেনাবাহিনীর অফিসার হওয়ার পর আমাকে কে ফোর্সের অন্তর্ভুক্ত করে যুদ্ধ এলাকায় পাঠানো হল। নভেম্বরের ১/২ তারিখের রাতে তুমুল বৃষ্টির মধ্যে আমাদের ৩ তা কোম্পানী এবং ২ য় বেঙ্গলের আরো একটা কোম্পানি নিয়ে বেলুনিয়া পকেটে যেতে হয়। পরশুরাম ও ফুলগাজির মাঝামাঝি পাকিস্তানীদের দুটি ক্যাম্পের মধ্যে প্রায় ১২০০ গজের গ্যাপ ছিল। এই গ্যাপের মধ্য দিয়ে রাতারাতি বাঙ্কার খুঁড়ে আমরা অবস্থান নিয়ে ফেলি। ভোরবেলা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা পেট্রোল পার্টি এই পথে আসে। এই পেট্রল পার্টি আসছিল ফেনী ও বেলুনিয়া রেললাইন দিয়ে একটি ট্রলিতে করে। ট্রলি যখন ঠিক আমাদের পজিশন এর ১০০ গজ দূরে এসে পরে তখনই তাদের উপর আমরা হামলা চালাই। ট্রলিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন লেফতেন্যান্ট ছিল। তার সাথে আর ১০ জন ছিল। তাদের সবাইকে অখানে আমরা ঘায়েল করি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পজিশন ছিল উত্তর দিকে বেলুনিয়া দক্ষিন দিকে ফুলগাজী এলাকা। তারা ধরেই নিয়েছিল এটা বোধ হয় একটা মুক্তিবাহিনীর এমবুশ। গোলাগুলির সঙ্গে সঙ্গে ফুলগাজী থেকে পাকিস্তানীদের রিইনফোরসমেন্ট চলে আসে। প্রায় ৪০/৫০ জন পাকসৈন্য আমাদের দিকে এগুতে থাকে হামলা চালানোর জন্য। ওরা যখন আমাদের রেঞ্জের মধ্যে চলে আসে তখন আমাদের সম্পূর্ণ ডিফেন্স রেল লাইনের পূর্ব পশ্চিম দিক এবং বেলুনিয়া ফেনী সড়ক যেটা রেল লাইনের সমান্তরাল এই দুই পজিশন থেকে একি সঙ্গে আমরা আক্রমন চালাই। আক্রমনে পাকিস্তানীদের ৪০ জনের বেশি হতাহত হয় এবং ৬/৭ জন বোধ হয় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এই সকল এমবুশে আমাদের পিছনে যে পাকিস্তানি পজিশন ছিল তারা শঙ্কিত হয়ে পরে। এবং তারা আমাদের মধ্য দিয়ে ব্রেক থ্রো করার চেষ্টা করে। তারা সেইদিন রাতেই পালাবার চেষ্টা করে কিন্তু ব্যর্থ হয়। পাকিস্তানীদের বেশীর ভাগই আমাদের হাতে ধরা পরে এবং সেদিন রাতেই ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনি পাকিস্তানী পজিশন এর উপর প্রচন্ড গোলাবর্ষণ করে। পরের দিন বেলুনিয়া থেকে পরশুরাম পর্যন্ত সম্পূর্ণ এলাকাটি হানাদার বাহিনী মুক্ত হয়। এটা ছিল নভেম্বরের ঘটনা।

 

প্রশ্নঃ পরবর্তীতে সব সময়ি কি এটা আপনাদের দখলে ছিল?

উত্তরঃ বস্তুতপক্ষে এর আগেও এই এলাকা আমাদের দখলে ছিল। বেলুনিয়ায় মুহূরী নদির পশ্চিম দিক থেকে নিয়ে শালদা নামে একটা স্থান পর্যন্ত বলা যায় সব সময়ি আমাদের দখলে ছিল। আর বর্তমান এয়াকা দখলের পর আমাদের এলাকা প্রায় তিনগুন বেড়ে গেল। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, এই এলাকাতে আমরা যখন তিনদিন পর্যন্ত একটানা পাকিস্তানি বাহিনির সঙ্গে যুদ্ধ করি তখন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বিমান আমাদের উপর হামলা চালায়। সেই বিমান হামলায় আমাদের দশ/বার জনের মত সৈন্য শহিদ হয় এবং ১৫/১৬ জনের মত আহত হয়।

 

এখানে আমাদের ডিফেন্স খুব স্ট্রং ছিল এবং মনোবল ও খুব দৃঢ় ছিল। সেই অটুট মনবলের জন্যই সময়মত এবং যথাযথ খাওয়াদাওয়া না পেলেও সৈন্যরা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে গেছে। পরবর্তী সময়ে ইন্ডিয়ান কোর কমান্ডার স্বগত সিং ব্যক্তিগতভাবে আমাদের এলাকা পরিদর্শনে আসেন এবং কমান্ডিং অফিসারকে অভিনন্দন জানান।

 

প্রশ্নঃ খাদ্যের ব্যপারে আপনাদের কিরকম অসুবিধা ছিল? খাবার কি ঠিকমত সরবরাহ হত না?

উত্তরঃ আমরা খাবার পেতাম। আমাদের ব্যাটেলিয়নের খাবার দেয়ার দায়িত্ব ছিল ইন্ডিয়ানদের তরফ থেকে। তবে আমাদের ব্যাতেলিয়নের যত সৈন্য অথরাইজড ছিল তার দ্বিগুন লোক আমাদের ব্যাটেলিয়নে ছিল। র কারন ছিল। মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে আমরা লোকজন সংগ্রহ করতাম এবং তাদেরকে আমাদের সঙ্গে রাখতাম। ফলে আমাদের সবাইকে যে মাসিক ভাতা দেয়া হত সেটা এবং যে খাবার নির্দিষ্ট ছিল তা শেয়ার করতে হত।

 

বেলুনিয়ায় নোয়াখালীর এমপি খাজা আহাম্মদ এবং তার লোকজনের সঙ্গে আমাদের খুব একটা সৌহার্দ্য ছিলনা। ফলে বেলুনিয়ার আওয়ামী লিগের তরফ থেকে তেমন কন সহযোগিতা পাইনি। তবে বেলুনিয়ার স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে সব সময় খুবই সহযোগীতা পেতাম। এ সময়ের একটা ঘটনার কথা আমার মনে পরে। আমাদের সৈন্যরা গিয়ে একটা এমবুশ করে পাকিস্তানি পজিশনের পেছনে সেটা ছিল অক্টোবরের শেষের দিকে। নিলকি নামে একটা গ্রাম ছিল সেখানে পাকিস্তানিদের বেশ ক্ষতি হয়। সেই গ্রামে আমি ছিলাম। সংঘর্ষের পরে আমি যখন চলে আসি সেইদিনই অর্থাৎ পরদিন ভোরবেলা পাকিস্তান সেনাবাহিনি সেই গ্রামটা জ্বালিয়ে দেয় এবং ৪০/৫০ জন লককে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তার মধ্যে ১৪ বছরের ছেলে ও ৮০ বছরের বৃদ্ধ ছিল। এই খবরতা পাওয়ার পর আমি মানুশিকভাবে খুব দুঃখ পাই এবং রাতের বেলা আবার ফেরত যাই সেই গ্রামে। গ্রামবাসীরা আমাদের দেখে শোকে ভারাক্রান্ত না হয়ে তারা আমাদেরকে আরো উৎসাহিত করতে থাকে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তারা আমাদের সর্বপ্রকার সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে।

 

সেই রাতে একজন বৃদ্ধা তিনি তার গরুর দুধ দুইয়ে আমাদেরকে দিলেন। অথচ তাঁরই নাতিকে সকালে পাকিস্তানি সৈন্যরা মেরে ফেলেছে। তিনি বলছিলেন যে, আমার নাতি গেছে ত কি হয়েছে। দেশ যদি একদিন স্বাধীন হয় তবে আমি সবাইকে ফিরে পাব। তোমাদের মাঝেই আমার নাতিকে পাব। গ্রামবাসীদের এই মনোবল আমাদেরকে শত্রুহননে আরো উৎসাহিত করে।

 

প্রশ্নঃ আমরা এমনও শুনেছি যে, মুক্তিবাহিনী গ্রাম থেকে আক্রমন চালালে পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তানি সৈন্য সেই গ্রামে হামলা চালাত সেই কারনে গ্রামবসীরা খুব ভয়ে ভয়ে থাকত। কিন্তু পরে যখন মুক্তিবাহিনী বিজয় হওয়া শুরু হল তখহন গ্রামবাসীরা দ্বিগুন উৎসাহে সাড়া দিতে লাগল। আপনাদের এই বিজয়গুলি গ্রামবাসীদের মনে কি রকম সাড়া জাগিয়েছিল?

উত্তরঃ এই প্রশ্নে আমি শুধু বলব, বেলুনিয়ার পর থেকে ফেনী এবং পরবর্তী পর্যায়ে চট্টগ্রামের দিকে যখন আমরা অগ্রসর হই তখন কোন ট্রেঞ্চ বাঙ্কার আমাদের লোকদের খনন করতে হয়নি গ্রামবাসিরা কোদাল নিয়ে এসে আমাদের সহযোগীতা করত, পাকিস্তানী সেনাবাহিনির গোলার আঘাতে গ্রামবাসিরাও হতাহত হত কিন্তু তবু তারা এগিয়ে আসত। তাদের মনোবল ছিল অটুট। গ্রামবাসীর মনোবল কত অটুট ছিল সে সম্পর্কে আমি এখানে একতা ঘটনার উল্লেখ করব। দিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ইন্ডিয়ান একটি পেট্রোল পার্টি পাকিস্তানি পজিশনের পিছনে চলে যায়। পাকিস্তানীরা দেখতে পেয়ে তাদের উপর অবিরাম গোলাবর্ষণ করে। এক সময় ইন্ডিয়ান পেট্রল পার্টির গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাচ্ছিল সে সময় তারা খবর পাঠায় গোলাবারুদ সরবরাহের জন্য। আমাদের গ্রামের লোকজন সেই গোলাবারুদ বহন করে নিয়ে যায় প্রায় সাত মাইল পথ অতিক্রম করে। পরে ভারতীয় পেট্রল এ যে অফিসার ছিল তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। তিনি তখন বলেছিলেন যে, যে দেশের লোকজনের মনোবল এত শক্ত তারা স্বাধীন না হয়ে পারে না। তিনি আরো বলেন যে, ভারতীয়বাহিনীর যে নিয়মিত সাপ্লাই কোর আছে তারাও বধ হয় যুদ্ধক্ষেত্রে এত তাড়াতারি গোলাবারুদ্দ সরবরাহ করতে পারত না যতটা তাড়াতারি করেছে তোমাদের গ্রামবাসীরা।

 

প্রশ্নঃ এই যুদ্ধের আর কোন উল্লেখযোগ্য দিক আছে কি?

উত্তরঃ উল্লেখ করার আছে। এই যুদ্ধের পরে যখন আমরা পাকিস্তানি ট্রেঞ্চ ও বাঙ্কারে তল্লাসি চালাই তখন আমরা একটি ধর্ষিত মহিলার লাশ পাই। বাঙ্কারের পাশে মহিলার সঙ্গে একটি মৃত বাচ্চা ছিল। পাকিস্তানীরা যে কি চরম বর্বরতা দেখিয়ে গেছে সেগুলি আজ আমরা ভুলে গেছি যার জন্য আজকাল আমরা মুক্তিযুদ্ধকে মনে করি একটি দুর্ঘটনা।

 

প্রশ্নঃ এছাড়া পাকিস্তানি বর্বরতার আর কোন ঘটনা মনে পড়ে কি?

উত্তরঃ আমি ঢাকায় দেখেছি ২৫ শে মার্চের পরে বাঙ্গালির মৃতদেহ কিভাবে রাস্তায় রাস্তায় পরে ছিল এবং আমাদের এনকাউন্টারে আমরাও পাকিস্তানী লাশ এভাবে রাস্তায় ফেলে রেখে যেতাম এটা আমাদের একটা প্রতিহিংসার বহিঃপ্রকাশ ছিল। এই সংঘর্ষের পরে পাকিস্তানিরা পুরো বেলুনিয়া ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় এবং ফেনীতে গিয়ে পজিশন নেয়।

 

ফেনিতে আমরা সামনাসামনি ডিফেন্সে দু সপ্তাহের কিছু বেশী থাকি। এখানে প্রায়ই পেত্রলিং হত গোলাগুলি হত মাঝে মাঝে ওরা আমাদের ডিফেন্সের উপর আক্রমন করত এবং পাকিস্তানিদের প্রতিটি আক্রমনই এখানে প্রতিহত করা হয়েছিল এবং ফেনি পুরপুরি ফল করে ডিসেম্বরের ৪/৫ তারিখে। সে সময় পাকিস্তানীরা ফেনী ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। কারন পাকিস্তানিদের পিছনের সঙ্গে সকল যোগাযোগ সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। আমাদের গেরিলারা সে সময় পাকিস্তানীদের খুব নাজেহাল করছিল। ৫ ই ডিসেম্বরের ভোরে তারা রাতারাতি চলে যায় লাকসামের দিকে। ভরবেলা আমরা দেখলাম পাকিস্তানী ডিফেন্স শুন্য। এর আগে আমাদের একটি পেট্রোল পার্টি গিয়েছিল। তারা ফেরার পথে পরিখায় অবস্থানরত রাজাকারদের পাকড়াও করে। তারা এখনো জানত না যে, পাকিস্তানী আর্মি ভেগে গেছে। ফেনির মুলত সেদিনই পতন ঘটে। সেদিন সত্যি ই আমাদের আনন্দের দিন ছিল। আমার মনে সব সময় একতা ইচ্ছা ছিল যে মৃত্যুর আগে যেন অন্তত বাংলাদেশের একটি শহর মুক্ত স্বাধীন দেখে যেতে পারি।

 

এরপর আমাদের নোয়াখালির আনাচে কানাচে যেতে হয় পাকিস্তানি সেনার কিছু অবস্থানকে মুক্ত করতে। এখানে একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল এই যে, চৌমুহনি ও মাইজদী কোর্টে রাজাকারদের রেজিসটেন্স। রাজাকারদের দুর্ভেদ্য ব্যুহ নাকি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চাইতেও ভাল ছিল। রাজাকারদের বড় বড় নেতারা ও কিছু হাফ ফোরস চৌমুহনী ও মাইজদী কোর্টের দালান কোঠায় উঠে পজিশন নিয়ে আমাদের বেশ ক্ষতি সাধন করে। তারা সহজে সারেন্ডার করেনি। শেষ পর্যন্ত আমাদের বল প্রয়োগ করে সারেন্ডার করতে হয়। এর পর আমাদের ব্যাটেলিয়ন মুভ করে  চিটাগং এর দিকে। চিটাগং এর দিকে আমরা এডভান্স করি ৯ ই ডিসেম্বর থেকে।

 

চিটাগং এর দিকে যখন আমরা এডভান্স করি তখন সীতাকুন্ডে পাকিস্তানিরা আমাদের প্রতিরোধ করে।

 

১০ তারিখে আমরা সীতাকুন্ডে পৌছাই। এরপর যখন আমরা কুমীরার কাছাকাছি আসলাম তখন আমাদের দুই ব্যাতেলিয়নকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটা অংশ আমাদের শিওর নেতৃত্বে তিন কোম্পানীসহ পাহাড়ের উপর দিয়ে চিটাগং ইউনিভার্সিটির দিকে যায়। সেখানে বহু পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। আমাকে রাখা হল ইন্ডিয়ান আর্মির সঙ্গে ঢাকা চিটাগং ট্রাঙ্ক রোডে। ভারতীয় দুটো ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে আমাদের অংশগ্রহন করতে হয়। একটা হল কুমীরায়। সেখানে দুদিন পাকিস্তানী আর্মি আমাদের সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমন প্রতিহত করে। তৃতীয় দিন আমরা রাতে ডান ফ্ল্যাঙ্ক দিয়ে ঢুকে পরি। এই গ্রুপে শুধু মুক্তিবাহিনী ছিল অর্থাৎ আমার কোম্পানিই ছিল। আর ছিল ১ নম্বর সেক্টরের একতি কোম্পানী। আমরা পাকিস্তানি ডান ফ্ল্যাঙ্ক দিয়ে যখন চলে আসি তখন তদের সঙ্গে আমাদের প্রচুর গোলাগুলি হয়। এতে আমাদের বেশ হতাহত হয়। সে সময় পাকিস্তানিরা কুমীরা ছেড়ে পিছু হটতে শুরু করে এবং আমরা পাকব্যুহে ঢুকে পরি। এই সময় ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী ভুলবশতঃ আমাদের উপর গোলাবর্ষণ করে। আমাদের ব্যাটেলিয়ন তখন খাকি ড্রেস পরত। ভারতীয়রা মনে করেছিল পাকিস্তানী সৈন্য আর তাই তারা গোলাবর্ষণ করেছিল। যাই হোক তারা তাড়াতাড়ি শুধরে নেয়। কারন একজন ইন্ডিয়ান ওপি ছিলেন যাকে আমি চিনতাম। তিনি আমাকে এবং আমার লককে চিনতে পেরেছিলেন। ফলে তেমন কন ক্ষতি আমাদের হয়নি। দু একটা গোলা পরেছিল কিন্তু কোন  হতাহত হয়নি। তবে হতাহত হতে পারত যদি কোন ভারতীয় অফিসার আমাদের না চিনতেন। কুমীরার পরের রেজিস্ট্যান্স টা হয় এখন যেখানে তার এক মাইল উত্তরের। সেখানে ১৬ ই ডিসেম্বর যখন সারেন্ডার আরম্ভ হয়েছে পাকিস্তান আর্মির দুইজন অফিসার সর্ব প্রথম আমার ডিফেন্সে এসে সারেন্ডার করে। তখন আমি ইন্ডিয়ান আর্মিকে খবর দেই। কমান্ডিং অফিসার এবং একজন ব্রিগেডিয়ার আসেন। আত্মসমর্পণকারী দুজন পাকিস্তানি অফিসারের একজন হচ্ছেন গোলন্দাজ বাহিনীর ক্যাপ্তেন ইফতেখহার আর একজন লেঃ ছিলেন তার নামটা আমি ভুলে গেছি। উনি বোধ হয়  ৪৬ ই এম এর। ১৭ ই ডিসেম্বর যখন ইন্ডিয়ান আর্মি মুভ করল চিটাগং শহরে তখন ইন্ডিয়ান আর্মি সিদ্ধান্ত নেয় যে, আমাদেরকে ঢুকতে দেবে না; আমরা পরে ঢুকব। ইন্ডিয়ান ৩২ মাহারের সি ও ছিলেন লে; কর্নেল হরদেব সিং যেহেতু আমি তার সঙ্গে ছিলাম তিনি ব্রিগেড কমান্ডার এর আদেশ অমান্য করে বলেন যে, আমি ত্র সঙ্গে যাব। এবং আমার কোম্পানী নিয়ে ১৭ তারিখেই চিটাগং শহরে মুভ করি।

 

প্রশ্নঃ সেদিনই কি পাকিস্তান আর্মি সারেন্ডার করে?

উত্তরঃ জ্বী।

 

এখানে আনুষ্ঠানিক ভাবে কোন সারেন্ডার করানো হয়নি। পাকিস্তানি সেনার যে ২৪ এফ এফ ব্যাটেলিয়ন এখানে তাদেরকে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে আনা হয় এবং তারা সেখানে সারেন্ডার করে। আমি এই কলজে পড়াশুনা করেছি আর সেই কলেজেই পাকিস্তানি আর্মি সারেন্ডার করছে এটা আমার কাছে খুব আনন্দের বিষয় ছিল। এখানে উলেখযোগ্য যে, আমার সিইও যিনি ছিলেন লেঃ কর্নেল জাফর ইমাম উনি ২৪ এফ এফ এ ছিলেন। তারি ব্যাটেলিইয়ন এখানে সারেন্ডার করল আমাদের কাছে এটা বেশ আনন্দের ব্যপার ছিল। তাকে যখন তার ব্যাটেলিয়ন এর লোকজনকে দেখতে হল তখন অনেকেই কান্নাকাটি করল। লেঃ কর্নেল জাফর ইমামের ব্যাটসম্যান নানা কথা জিজ্ঞেস করতে করতে অঝোরে কাঁদতে থাকে।

 

প্রশ্নঃ আপনাদের ফরমেশন এ যেসব গেরিলা বা এফ এফ ছিল তাদের সঙ্গে কিভাবে সমন্বয় সাধন করতেন?

উত্তরঃ আমার ব্যাতেলিয়ন কমান্ডার প্রথমে সাবসেক্টর কমান্ডার ছিলেন। তিনি সাবসেক্টর চালাতেন। তারপর তিনি যখন ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার হলেন তখন সাবসেক্টর কমান্ডার হলেন একজন সিভিলিয়ান – ক্যাপ্টেন মজিবল হক। তিনি পরে এবং এখনো বোধ হয় ট্রেনিং কলেজের প্রিন্সিপ্যাল। তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুব ভাল ছিল। আমরা একসঙ্গে কাজ করতাম, লোকাল যারা গেরিলা  ছিল তারা আমাদের অর্ডার নিয়ে কাজ করত। কারন মজিবুল হক আমাদের সাথে আগে কাজ করেছিল তাই আমাদের কোন অসুবিধা হত না। আমরা তাদের যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারতাম।

 

প্রশ্নঃ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে কিভাবে সমন্বয় সাধন করা হত? সম্পর্ক কেমন ছিল?

উত্তরঃ এমনিতে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালই ছিল। তবে আমাদের সেনাবাহিনী চায়নাই যে, ৩ রা ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করুক। সেদিন আমাদের অনেক লোকই কেঁদেছিল।

 

প্রশ্নঃ ইতিমধ্যে, আপনার কথায় দেখতে পাচ্ছি যে, অনেকখানি জায়গা পুনঃদখল করে ভিতরে পৌঁছে গেছেন?

উত্তরঃ জ্বী, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আরো হয়ত দুবছর লাগবে কিন্তু বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবেই হবে।

Scroll to Top