সাক্ষাৎকারঃ আব্দুর রহমান, প্রাক্তন গণপরিষদ সদস্য

<৯, ১৩.৩, ৩৫৩-৩৫৫>

শাহজাদপুরসহ অন্যান্য স্থানের সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকার-আব্দুর রহমান, প্রাক্তন গণপরিষদ সদস্য

১২-১১-১৯৭৩

(বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র থেকে সংগৃহীত)

 

২৫শে মে দিবাগত রাত দুটোর সময় শাহজাদপুর থানার ওসি আমার কাছে একজন পুলিশ পাঠিয়ে সংবাদ দেন যে, “ঢাকায় সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহ হয়েছে এবং ইয়াহিয়া খানকে বন্দী করে রাওয়ালপিন্ডি পাঠিয়েছে। আপনি অবিলম্বে থানায় এসে সকলের সঙ্গে আলোচনা করে কর্তব্য নির্ধারণ করুন।” আমি ভেবে দেখলাম এ সংগ্রামের কেবল শুরু, অনেকদিন চলবে। কাজেই উত্তেজিত না হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। থানায় গিয়ে দেখি অনেক আওয়ামী লীগ কর্মীও এসেছেন। সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক হলো আমাদের প্রথম কাজ যোগাযোগের ব্যবস্থা বন্ধ করা। সেই অনুযায়ী বাঘাবাড়ীর ফেরী বন্ধ করার দায়িত্ব দিয়ে আবুল হোসেন চৌধুরীকে পাঠানো হলো। আমি উল্লাপাড়া ও তার পরবর্তী এলাকার কাজ কর্ম তদারক করার জন্য মোটর সাইকেলযোগে সেদিকে রওয়ানা দিলাম। উল্লাপাড়ার জনপ্রতিনিধি (এমপিএ) এলাকায় অনুপস্থিত থাকেন এবং রায়গঞ্জ থানার প্রতিনিধিও তাড়াশে থাকেন বিধায় ঐ এলাকার জরুরী দায়িত্ব পালন কর্তব্য মনে করে আমি ঐদিকে রওয়ানা দেই। প্রথমে আমি সরাসরি রায়গঞ্জ থানায় যেতে চাই। কিন্তু ঐ এলাকার রাস্তায় বড় বড় গাছ থাকায় রায়গঞ্জ থানা পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব না হওয়ার জন্য কিছু আওয়ামী লীগ কর্মীর সঙ্গে সমস্ত বিষয় আলোচনা করে তাদের কর্তব্য নির্ধারণ করে ফিরে আসি। উল্লাপাড়া থানায় এসে সেখানকার কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের কর্তব্যও নির্ধারণ করে ফিরে আসি। আমার এই কয়েক ঘন্টার সফরে জনসাধারণের যে আন্তরিকতা দেখেছি তার তুলনা হয় না।

 

সম্ভবতঃ ২৯/৩০ মার্চ আমি বঙ্গবন্ধুর শেষ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনামা পাই। আমি এটি অনুবাদ করার ও ছাপানোর ব্যবস্থা করি। ছাপানোর দায়িত্ব এককালীন কনভেনশন লীগ নেতা ও পার্লামেন্টারী সেক্রেটারী ও পরবর্তীকালের জেলা শান্তি কমিটির প্রধান মৌলানা সাইফউদ্দিন ইয়াহিয়া সাগ্রহেই নিয়ে ছিলেন ও দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করেছিলেন।

 

এই সময়ে ‘শাহজাদপুর স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। শাহজাদপুরের আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ কর্মী ও সরকারী কর্মচারীদের মিলিত সভায় সাতজন সদস্যের সমন্বয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়। আমি ঐ সভায় সভাপতিত্ব করি এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদেরও সভাপতি নির্বাচিত হই। এই কমিটির সদস্যগণ ছিলেনঃ

১) জনাব আবদুর রহমান (এমপিএ)-সভাপতি

২) জনাব আবদুল লতিফ খান

৩) জনাব আবুল হোসেন চৌধুরী

৪) তাহাজ্জদ হোসেন (অধ্যক্ষ)

৫) বাবু ননী-গোপাল সাহা

৬) সিআই, পুলিশ স্টেশন

৭) ওসি, পুলিশ স্টেশন

 

শাহজাদপুরে স্বাধীনতা যুদ্ধের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব এই কমিটির উপর থাকলেও অন্যান্য অত্যন্ত জরুরী কাজের জন্য কয়েকটি উপ-কমিটিও গঠন করা হয়। খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া ছিলো ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগ দলীয় এমএলএ জনাব আবু মোহাম্মদ ইউনুস সাহেবের উপর। টাকা পয়সা সংগ্রহের দায়িত্ব ছিলো বাবু বিনোদবিহারী জোয়ারদারের উপর। প্রচারের দায়িত্ব ছিলো জনাব আবদুল গফুর সবরতের উপর।

 

আমরা প্রথম থেকেই আমাদের অস্ত্রের অপ্রতুলতার কথা জানতাম। ইতিমধ্যে সংবাদ পেলাম যে, বগুড়ার নির্মীয়মান ক্যান্টনমেন্ট ওখানকার মুক্তিযোদ্ধারা দখল করেছে। আমি বেড়ার জনপ্রতিনিধি এমএনএ জনাব আবু সাইদের সঙ্গে যোগাযোগ করে উভয়ে কয়েকজন কর্মীসহ বগুড়া গেলাম। এটা এপ্রিলের ৪ তারিখ। সেখানে গিয়ে ঐদিন লোক ও অস্ত্র না পেয়ে আমাদের কর্মীদের চান্দাইকোনা রেখে আমি ও আবুল চৌধুরী ফিরে এলাম। এলাকার কাজের জন্য আমাকে ফিরে আসতে হলো। আমি ফিরে এসে নগরবাড়ী এলাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেখতে গেলাম। কারণ ঐ সময়ে নগরবাড়ী রক্ষা করা না গেলে আমাদের বাঘাবাড়ী রক্ষা প্রচেষ্টার কোনো মানেই থাকবে না। নগরবাড়ীতে কোনো জনপ্রতিনিধি না থাকায় আমার পক্ষে ঐ স্থানের কাজকর্ম বাদ দিয়ে আসা সম্ভব হলো না।

 

নগরবাড়ীতে আমি নিয়োজিত থাকায় বগুড়াতে না যেতে পেরে আবুল চৌধুরীকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠালাম। সেখান থেকে আমাদের খুব সামান্য অস্ত্রই দেয়া হয়েছিলো। যাই হোক, নগরবাড়ীতে আমাকে এবং ক্যাপ্টেন (বর্তমানে মেজর) নাজমুল হুদাকে সব সময় একসঙ্গে পরামর্শ করেই কাজ করতে হতো। পাবনা থেকে বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা এসেছিলো। আমি এবং ক্যাপ্টেন হুদা প্রথমেই স্পীডবোট নিয়ে সমস্ত নদী এলাকা ঘুরে দেখলাম। দেখলাম যে, পাক বাহিনী নগরবাড়ীতে সরাসরি না এসে নগরবাড়ীর ৮/৯ দক্ষিণ দিক দিয়েও পার হয়ে নগরবাড়ী-পাবনার পাকা রাস্তায় উঠতে পারে। আমরা সেজন্য ঐ সমস্ত এলাকায় গিয়ে জনসাধারণকে প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়ে আসি।

 

৯ই এপ্রিল বেলা ৪টার দিকে পাক বাহিনী বিমান আক্রমণ করে আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কয়েকজন আহত হয়। বিমান আক্রমণের কথা আমরা এতটা ভাবি নাই। সতর্কতার কোনো উপায় ছিলো না। কারণ পাবনা গিয়ে আমি ও ক্যাপ্টেন হুদা মেশিনগান নিয়ে আসি। পরে দেখা গেলো সেটার পিন ভাঙ্গা। এর দুই দিন আগে ঈশ্বরদী থেকে একটা হাত সাইরেন আনা হয়েছিলো। সন্ধ্যার পর দেখা গেলো সেটার একটা পার্টস কেউ ভেঙ্গে রেখেছে যে বাজানো যায় না।

 

ক্যাপ্টেন হুদা বারে বারেই অস্ত্রের কথা বলছিলেন। কিন্তু পাবনা ও বগুড়া ছাড়া আর কোথাও আমার চেষ্টা করার জায়গা ছিলো না। তৎকালীন ডিসি জনাব নুরুল কাদের খানের মাধ্যমে চেষ্টা করে কুষ্টিয়া থেকে কিছু আনসার আনা হয়েছিলো। কিন্তু প্রথম দিনের বিমান আক্রমণের পরই তারা চলে যায়।

 

পরদিন ১০ই এপ্রিল সকালে আবার বিমান আক্রমণ হয়। ঐদিন আমাদের কেউ হতাহত হয়নি। শুধু কয়েকজন গ্রামবাসী মারা গিয়েছিলো তবে আমাদের পুরো বাহিনী বিশৃঙ্খল হয়ে যায়।

 

বাঘাবাড়ী প্রতিরোধঃ শাহজাদপুর এসে আমি বাঘাবাড়ীতে প্রতিরোধ গড়ার উদ্যোগ নেই। এমন সময় সিরাজগঞ্জের তৎকালীন এসডিও জনাব শামসুদ্দিন আসেন এবং যুদ্ধের প্রধান কাজকর্ম তিনি উপস্থিত থেকে করান। তিনি অবশ্য পরে শাহজাদপুরে ছিলেন না, মাঝে মাঝে আসতেন।

 

নগরবাড়ী থেকে আসার পর আমি বগুড়ার সাথে যোগাযোগ করি। সেখান থেকে বেশ কিছুসংখ্যক ইপিআর আসে। তাদের নিয়ে প্রথমে বেড়া যাই। পরবর্তী সময়ে জনাব শামসুদ্দিনের সঙ্গে পরামর্শ করে একদিন রাতে আমরা নগরবাড়ীতে অবস্থানরত পাক বাহিনীকে আক্রমণ করার প্রোগ্রাম করি। কিন্তু অনেকের বিশেষ করে ট্রাক ড্রাইভারের অসহযোগীতার জন্য ঐ আক্রমণ সফল হয় নাই। আমরা নিজেরা প্রায় দুই ঘন্টা ধাক্কিয়েও ট্রাক সচল করতে পারিনি। অতঃপর ভীষণ বৃষ্টি ও বাতাসে খেজুরপাতার পাটিতে খোলা ঘরের মাটিতে শুয়ে থেকে ঠান্ডায় যখন হাত পা হিম হয়ে এসেছিলো তখন আমরা কোনোক্রমে রাত ৪টায় বেড়া সিএণ্ডবি ডাকবাংলোয় চলে আসি। ঘন্টাখানেক পর সমস্ত বাহিনীও বৃষ্টিতে ভিজে ফিরে আসে। আরও কয়েকটি আক্রমণের পরিকল্পনা আমরা করলেও নানা ত্রুটির জন্য তা সফল হয় নাই।

 

অবশেষে ১৯শে এপ্রিল পাক বাহিনীই বেড়ার ডাব-বাগানে অবস্থানরত আমাদের বাহিনীর উপর আক্রমণ করে। উভয় পক্ষেই প্রচুর ক্ষতি হয়। পরের দিনই বাঘাবাড়ীতে অবস্থানরত আমাদের সংগৃহীত ও সিরাজগঞ্জের সশস্ত্র বাহিনী ঐ এলাকা ত্যাগ করে। তার পরদিন আমার কাছর খবর আসে যে, ডাব-বাগানে আমার পক্ষে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের কবর দেওয়া হয় নাই। আমি দুইজন কর্মী নিয়ে অমনি রওয়ানা দেই। কিন্তু বেড়া পৌঁছার পর ঐ স্থানের কর্মীরা আর আমাদের অগ্রসর হতে দেয় নাই।

 

২২শে এপ্রিল পাক বাহিনী বাঘাবাড়ীতে এসে শাহজাদপুরকে লক্ষ্যে করে শেল মারতে থাকে এবং তারপর বাঘাবাড়ী ও শাহজাদপুরের পতন হয়।

Scroll to Top