সাংবাদিকদের হরতাল

<2.37.221-223>

পাকিস্তানজুড়ে বিক্ষোভ
সাংবাদিকদের ধর্মঘট

সংবাদমাধ্যমের ওপর দুটো প্রাদেশিক অধ্যাদেশ দ্বারা নতুন করে কড়াকড়ি আরোপের প্রতিবাদে সোমবার সাংবাদিক, সংবাদপত্র ও সংবাদসংস্থার কর্মীরা সারা দেশজুড়ে ধর্মঘট এবং বিক্ষোভ করেছেন, সাংবাদিকতার ইতিহাসে যা নজিরবিহীন। মঙ্গলবার দেশে কোন পত্রিকা প্রকাশিত হয় নি।

খাইবার পাস থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সকল প্রধান নগরে স্লোগানদানকারী এবং কালো পতাকা বহনকারী সাংবাদিকরা তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করেন এবং “কালো আইনের” প্রতিবাদে  নগরের রাস্তায় মিছিল করেন।

পূর্ব পাকিস্তানে সংবাদকর্মীরা বিক্ষোভ দিবস পালন করেন এবং চার দফা দাবির প্রতি তাঁদের পূর্ণ সমর্থন জানান। ইতোপূর্বে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক সমিতি (EUPJ) কর্মকমিটি প্রণীত দাবিগুলো হচ্ছে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রেস অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার, বিদ্যমান সকল সংবাদমাধ্যম আইনের পরিমার্জনা, ঢাকার তিন দৈনিকের কালোতালিকাভুক্তি প্রত্যাহার এবং আটক সাংবাদিকদের মুক্তি।

ঢাকায় সাংবাদিক এবং সংবাদকর্মীরা প্রেসক্লাবে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন, শপথ গ্রহণ করেন এবং বিশাল মিছিল বের করেন।

বিক্ষোভ সমাবেশের পূর্বঘোষিত সময় সকাল ৯.৩০ টার অনেক আগে থেকেই দৃশ্যতঃ যুদ্ধপ্রেরণাবদ্ধ কালো ব্যান্ড পরা বিক্ষোভকারীরা দলে দলে স্থানীয় প্রেস ক্লাবে সমবেত হতে শুরু করেন।

আকরাম খানের বক্তব্য
সমাবেশে স্থানীয় সংবাদপত্র সম্পাদকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন, এদের মধ্যে ছিলেন দৈনিক আজাদের আশি বছর বয়স্ক মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খান, ভারতীয় উপমহাদেশের বয়ঃজ্যেষ্ঠ সম্পাদক। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী বিচারপতি জনাব ইব্রাহিম বিক্ষোভ সমাবেশের ভেন্যু প্রেসক্লাবে আসেন, এবং কালো ব্যান্ড পরে “চিন্তার নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে” পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন।
প্রতিবাদ মিছিলের পূর্বে বক্তব্য প্রদান করে দিনের স্বর নির্ধারণ করে দেন মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খান। আবেগরুদ্ধ্ব স্বরে তিনি বলেন, “আমার বয়স বেড়ে যাওয়ায়, শক্তি কমে যাওয়ায় আমাকে শয্যাশায়ী হতে হয়েছে, কিন্তু দেশে যা হচ্ছে তাতে করে আমি উঠে দাঁড়াতে, আপনাদের বিক্ষোভে নিজেও সমবেত হতে বাধ্য হয়েছি।”
বিভিন্ন শাসনামলে ৬৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা করার পর [এই মুহূর্তে এসে] কারাগারে মৃত্যুবরণ করবেন কি না, এ ব্যাপারে তিনি তাঁর ভাবনা প্রকাশ করেন; তিনি ঘোষণা করেন, তিনি হাসিমুখে প্রস্তুত থাকবেন।
মাওলানা আকরাম খান বলেন, সংবাদমাধ্যমের ওপর এ বিধিনিষেধ শুধুমাত্র সংবাদমাধ্যমের ওপরই নয়; বরং তা “সমগ্র জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়া”।
বিক্ষোভকারীদের সতর্ক করে দিয়ে মাওলানা বলেন, বিভিন্ন মহল থেকে অনেকভাবেই উসকানি দেয়া হতে পারে, কিন্তু আমাদের তা থেকে সাবধান থাকতে হবে এবং যে কোন মূল্যেই হোক, শান্তি রক্ষা করতে হবে।
“The more they tighten the fetters on us. The more these shall fall off. The more they redden their eyes, the more our eyes see into the things”, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে এ উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করেন।
ইত্তেফাকের সম্পাদক এবং IPI, পাকিস্তান শাখার চেয়ারম্যান জনাব তোফাজ্জল হোসেন সংবাদমাধ্যমের ওপর ভর করা আশঙ্কার পাশাপাশি ইতিবাচক দিকের কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সংবাদমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করার পর সংবাদপত্র শিল্প ও সংবাদকর্মীদের মধ্যে গড়ে ওঠা ঐক্য জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়।
তিনি বলেন, এ সংকট শুধু সাংবাদিকদের ও তাঁদের পেশার জীবন মরণ সংকট নয়, এটি অবাধ ও মুক্ত একটি জাতির জীবন মরণ প্রশ্নও বটে। তিনি বলেন, সাংবাদিক-সংবাদকর্মী-সংবাদপত্রমালিকদের এ দৃঢ় ঐক্যই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য সবচেয়ে কার্যকর ঢাল।
দীর্ঘায়িত সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি
পাকিস্তান অবজারভারের সম্পাদক জনাব আব্দুস সালাম বলেন, এ দিনটি লড়াইয়ের শপথ নেয়ার, কেননা এ সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হবে। তিনি বলেন, সরকার চোখ বুঁজে আছে, তারা এভাবেই আরো অনেকদূর যেতে প্রস্তুত; তাই আমাদের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অর্জন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
EPUJ কর্মকমিটির চেয়ারম্যান জনাব সিরাজউদ্দীন হোসেন সভায় সভাপতিত্ব করেন। তিনি ধর্মঘটরত সাংবাদিক, সংবাদকর্মী এবং স্থানীয় সম্পাদকদের ঐদিনের কার্যক্রমে যোগদান করার জন্য ধন্যবাদজ্ঞাপন করেন। তিনি ইতোমধ্যে শুরু হতে যাওয়া মিছিলে শান্তি-শৃংখলা রক্ষার ওপর জোর দেন।
সিদ্ধান্তসমূহ
সভায় নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়:
১) সংবাদকর্মী, সাংবাদিকদের এ সভায় পাকিস্তানের জাতীয় সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে সরকারের কালো আইনের প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে।

কন্ঠরুদ্ধ সংবাদমাধ্যম জাতির কলংক এবং চরিত্রগতভাবেই জাতীয়তাবোধের বিরোধী। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সকল স্বাধীনতার ভিত্তি। সংবাদমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা তাই পরিস্কারভাবেই জনগণের মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করার সমান। মুক্ত সংবাদমাধ্যম না থাকলে জনগণও মুক্ত থাকতে পারে না। সংবাদকর্মী এবং সমগ্র সংবাদপত্র শিল্পের বিরুদ্ধে নেয়া দমন-পীড়নমূলক ব্যবস্থা জাতির অস্তিত্বে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে।  জনগণের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে, জনগণের গণতন্ত্রের শ্বাসরোধ করা হচ্ছে।

এরূপ জটিল অবস্থায় দেশ ও জাতির কল্যাণকামী সকল মানুষ এগিয়ে এসেছেন। যত মূল্য দিয়েই হোক, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করতেই হবে।

সংবাদকর্মীরা গত সেপ্টেম্বর ২, ১৯৬৩ তারিখে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্ণরদ্বয়ের ঘোষিত সংবাদপত্র এবং প্রকাশনা (সংশোধনী) অধ্যাদেশ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।

সংবাদমাধ্যম বিষয়ক সকল আইন সংশোধন, যাতে মৌলিক অধিকারের নীতিগুলোর সাথে, বিশেষ করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে আইনগুলোর অবস্থান অনুরূপ থাকে।

এ ব্যাপারে কাজ করার জন্য সুপ্রীম কোর্ট অথবা হাই কোর্টের বিচারক, সাংবাদিক-সংবাদপত্রশিল্পের পেশাজীবীদের এবং সরকারের প্রতিনিধিবৃন্দের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন।

ঢাকার তিন দৈনিক পত্রিকার নাম “কালোতালিকা” থেকে অপসারণ, আটক সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের মুক্তি এবং তাঁদের বিরুদ্ধে আনীত সকল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ও বিধিনিষেধ প্রত্যাহার।

সাংবাদিক, সংবাদকর্মী এবং সংবাদপত্রে কর্মরত অন্যান্য কর্মজীবীরা উক্ত দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত এবং পাকিস্তানে সংবাদমাধ্যমের মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের লড়াই চালিয়ে যাবার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।

সভায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার লড়াইয়ে সহানুভূতিশীল যাঁরা একযোগে কাজ করেছেন, তাঁদের প্রতি সম্মান জানানো হয়। একইসাথে, কর্মরত সাংবাদিক, সংবাদকর্মীদের ঐক্যের কথাও গর্বের সাথে উল্লেখ করা হয় এবং এ ঐক্যকে ভবিষ্যতে আরো দৃঢ় করার আহ্বান জানানো হয়।

 

Scroll to Top