রাজনৈতিক মঞ্চ

রাজনৈতিক মঞ্চ

২ নভেম্বর, ১৯৭১

পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে মূল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও গোপন দুরভিসন্ধি সে কি ছিলো গত চব্বিশ বছরে বাংলাদেশের মানুষ তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টির মূল রহস্যের উপসংহার ঘটালো গত ২৫ মার্চ থেকে জন্ম নিলো স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। বাংলাদেশের লাখো মানুষের গলিত লাশের তলায় কবর হয়ে গেল পাকিস্তানের। বাংলাদেশের কিছু অশের উপর আজও যেহেতু দখলদার হানাদার বাহিনী তাদের মরা পাকিস্তানের লাশকে জিন্দা করার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় লিপ্ত সেই কারণে বাংলাদেশ মৃত পাকিস্তান রাষ্ট্রের সম্পর্কে দু’চার কথা বলার অবকাশ আজও আছে। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, রাজনৈতিক কর্মী, যুদ্ধরত তরূণ এবং কৃষক-মজুর সকল শ্রেণীর মানুষকেই জানতে হবে পাকিস্তান নামক সেই মৃত রাষ্ট্রের প্রকৃত শ্রেণী-চরিত্র কি ছিলো, এবং কোন অনিবার্য কারণে তার মৃত্যু ঘটলো। এবং বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকাসমূহ থেকে আমরা শত্রু বাহিনী তথা শত্রু র নাম-নিশানা ও অস্তিত্বকে কেনই বা দ্রুত নিশ্চিহ্ন করতে চাইছি। এসব বিষয়ে আমাদের প্রত্যেকের ধারণা আজ স্পষ্ট হতে হবে।

একথা সবাই জানেন যে পাকিস্তান সৃষ্টির জন্যে যে মূল রাজনৈতিক শক্তি কাজ করেছিলো তার নাম হলো মুসলিম লিগ। এই মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিলো দুটি শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্যে। একটি হলো বিভাগপূর্ব ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মুসলমান জমিদার শ্রেণী এবং অপরটি হলো তদানীন্তন ভারতের গজিয়ে ওঠা

মুসলমান বণিক শ্রেণী, যারা সে সময় ভারতবর্ষের অন্যান্য বণিক শ্রেণীর কাছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়েছিলো। বাংলাদেশের মানুষকে বোঝানো হয়েছিলোঃ যেহেতু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায় মূলতঃ কৃষিজীবী, সেই কারণে তাদের মুক্তি নিহত আছে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু অমুসলমান জমিদার, জোতদার ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অমুসলমানদের উৎখাতের মধ্যে। মুসলিম লীগ বাংলাদেশে এই সাম্প্রদায়িক প্রচার জোরদার করে কাজ হাসিল করে নিল। আসল উদ্দেশ্য ছিলো দেশের অর্থাৎ গোটা পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগের বাসস্থান বাংলাদেশকে বর্তমান পশ্চিম পাকিস্তান এবং ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত উদ্বাস্তু বণিক শ্রেণীর একটি স্থায়ী উপনিবেশে পরিণত করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, সরলপ্রাণ বাংলাদেশের মানুষ প্রথম দিকে তাদের এই গোপন দুরভিসন্ধি ধরতে পারেনি। তারা আশা করেছিলো দেশ ভাগ হলে সামন্ত ও আমলাদের হাত থেকে তারা মুক্তি পাবে। সোনার বাংলা তার হৃত শ্রী আবার ফিরে পাবে। এই আশাতেই বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায় মুসলিম লীগকে প্রথম দিকে সমর্থন করেছিলো। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই পাকিস্তানের অবাঙালী কায়েমী স্বার্থবাদী ও পুঁজিপতিদের আসল রুপ প্রকাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রকাশ পেলেও শুরু থেকে বাংলাদেশের আপামর সাধারণের মধ্যে ব্যাপকভাবে তার প্রক্রিয়া হতে থাকে। বাংলাদেশের সচেতন ছাত্রসমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহলের মধ্যেই তা সীমিত ছিলো। এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনও ওই পর্যায়ের মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছিলো। পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদীরা কিন্তু শুরুতেই আর একটা খেলা খেলেছিলো। সেটা হলো ভারত-বিরোধী সাম্প্রদায়িক প্রচার এবং আসল উদ্দেশ্যে সিদ্ধির জন্যে এই সাম্প্রদায়িক প্রচারকে স্থায়ী করতে তারা ১৯৮৪ সালে কাশীর আক্রমণ করে। জন্মলগ্নে কাশীর নিয়ে ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগের পক্ষে একটা সুবিধে হয়ে গেল। তারা কাশ্মীরকে পাকিস্তানের প্রথম এবং প্রধান জাতীয় সমস্যারূপে চিহ্নিত করলো। এবং কাশ্মীর সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা দেশের চিন্তা-ভাবনা, রাজনীতি, অর্থনীতি সমাজনীতি প্রভৃতি সবকিছুই যাচাই করতে লাগলো। প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ নেতারা কাশ্মীরের দোহাই দিয়ে এগুতে লাগলো তাদের আসল উদ্দেশ্যের পথে। এর মধ্যে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি ও ক্ষমতার ভাগবোটোয়ারা নিয়ে আত্মকলহ যে বাধেনি তা নয় । বরং বলা যায় তাদের নিজেদের মধ্যকার কলহ-বিবাদ চরমে পৌছেছিলো, আর তারই ফলশ্রুতি হিসেবে দেশে ঘটলো সামরিক অভ্যুত্থান। গজিয়ে ওঠা পুঁজিপতি ও আমলারাও তথাকথিত নেতাদের ঝগড়া-বিবাদ ও কামড়াকামড়িতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে সমারিক শাসনকে সমর্থন করে চললো। তারা সাপমরিক শাসনের সাহায্যে নিয়ে রাতারাতি ফুলে উঠতে লাগলো। ক্রমে ক্রমে বাংলাদেশকে পশ্চিমক পাকিস্তানের একটি লাভজনক উপনিবেশে পরিণত করার সব রকম আয়োজন তারা গ্রহণ করলো। আইয়ুবের ছত্ৰচ্ছায়ায় অর্থাৎ আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের ছত্ৰচ্ছায়ায় তাদের গতি হলো অপ্রতিরোধ্য। অন্যদিকে এই দীর্ঘকালীন সামরিক শাসনে দেশের গণআন্দোলনের সর্বনাশ করা হলো। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশে যে গণআন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিলো আইয়ুব তাকে গুঁড়ো করে দিলো।

পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্ৰীয় কাঠামোয় বাংলাদেশকে বঞ্চিত করতে চেষ্টা করা হয়। গোটা দেশের সমস্ত চিন্তা-ভাবনা সাম্প্রদায়িককতা ও ভারতবিদ্বেষের প্লাবন বইতে দিয়ে তারা এপথে এগিয়েছে। সচেতন বাঙালীরা যে এ সম্পর্কে কিছু জানতে পারেননি তা নয়, কিন্তু জানতে পারলেও পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদীদের চক্রান্ত ও উগ্র সাম্প্রদায়িকতার প্লাবনের মুখে তাদের করার কিছু ছিলো না। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বাংলাদেশকে যে কিভাবে বঞ্চিত করা হয়েছিলো তার প্রথম একটা চিত্র পাওয়া গেল আইয়ুবের শাসনামলে ১৯৬৩ সালে। এই সময় সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে বাঙালীদের সংখ্যা ছিলো শতকরা ৫ ভাগ, বিমান বাহিনীতে ছিলো শতকরা ৩ থেকে ৪ ভাগ এবং নৌবাহিনীতে ছিলো শতকরা ৩ ভাগ।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশকে পুরোপুরি ফাঁকি দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্বেও এর কৃষি উন্নয়নের জন্যে কোন রকম ব্যবস্থা করা হয়নি। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান-অনুর্বর অনাবাদী পশ্চিম পাকিস্তানকে কৃষি ও খাদ্যশস্যে স্বনির্ভর করে তোলার জন্যে

সর্বপ্রকার চেষ্টা করা হয়েছে। এদিকে বাংলার যে সোনালী আশে পশ্চিম পাকিস্তানটা গড়ে উঠলো তাকেও শেষ করার চেষ্টা করা হয়। পাটচাষ ও পাটচাষীদের কৃত্রিম অসুবিধে সৃষ্টি করা হয়। ১৯৪৯ সালে টাকার অবমূল্যায়ন নিয়ে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে বিরোধ বাধিয়ে বসায় ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের পাটের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেল এবং তাতে পাটচাষীরা ডুবে গেল।

শিল্পক্ষেত্রে বাংলাদেশকে পুরোপুরি বঞ্চিত করা হলো। সুতীবস্ত্র, পশমীবস্ত্র, ইস্পাত, কাগজ, রাসায়নিক দ্রব্য, যন্ত্রপাতি ও মেশিনারী শিল্প-কারখানাগুলোর মধ্যে সবগুলোই করা হলো পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্ববাংলায় বা বাংলাদেশে যা করা হলো তা অত্যন্ত নগণ্য, এবং তা করা হলো পশ্চিম পাকিস্তানী বণিক পুঁজিপতি তথা কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্বার্থেই। সরকারি খাতে বাংলাদেশে শিল্প বিনিয়োগ প্রায় শূন্যের কোঠায় রয়ে গেল। বেসরকারি বিনিয়োগ আরও শোচনীয়। সারা পশ্চিম পাকিস্তানকে সরকারি ও সরকরি সাহায্যপুষ্ট বেসরকারি শিল্প কারখানায় ভরে তোলা হলো। বাংলাদেশ হয়ে গেল পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপণ্যের বাজার। শুরু হলো বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ শোষণ। বাংলাদেশ পৃথিবীর বাজারে পাট বিক্রি করে ও চা বিক্রি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা পেতো তার শতকরা আশি ভাগেরও বেশি খরচ করা হতে লাগলো পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়ন ও শিল্প সম্প্রসারণের কাজে। পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকদের স্বার্থে বিদেশ থেকে সাধারণের প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের আমদানি বন্ধ করে পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিরা নিজেদের কারখানায় উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী অত্যাধিক চড়া দরে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি করে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করলো তাদের দ্বিমুখী শোষণ। রফতানি ও বৈদেশিক সাহায্যের সবখানি ফল ভোগ করতে লাগলো পশ্চিম পাকিস্তান। অতএব, দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বাংলাদেশকে বাদ দেয়া হয়েছে। তা যদি না দেয়া হতো তাহলে আর যাই হোক বাংলাদেশকেও ওদের কলোনীতে পরিণত করতে পারতো না। অবশ্য এ সবই হচ্ছে আজ গৌণ বিষয়। আজকের দিনের বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ পাকিস্তানীদের দীর্ঘদিনের শোষণের নাগপাশ ছিন্ন করে নিজেদের নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে স্বাধীন সার্বভৌগ গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার গঠন করেছে। দেশ থেকে হানাদার পাকিস্তানী সামরিক দস্যদের সম্পূর্ণ নির্মুল করার মহান লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা দ্রুতগতিতে।

(সাদেকীন রচিত)

Scroll to Top