রাজনৈতিক বঞ্চনার নেপথ্যে

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৮। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচারিত আরও বাংলা কথিকা “শব্দসৈনিক”

ফেব্রুয়ারি ১৯৭২

সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৭১

রাজনৈতিক বঞ্চনার নেপথ্যে

১৪ আগস্ট, ১৯৭১

আজ উনিশশো একাত্তর সালের চৌদই আগষ্ট। মাত্র এক বছর আগেও এই দিনে আমি ছিলাম ঢাকায়। আমার প্রিয় পরিজন, পরিচিত পরিবেশের মধ্যে। আমার চোখে কত স্বপ্ন, দেশ স্বাধীন, স্বাধীন দেশে এই প্রথম সাধারণ নির্বাচন আসন্ন। এই নির্বাচনে দেশে আসবে বাক-স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, নাগরিক স্বাধীনতা। সর্বোপরি দেশের মানুষ পাবে তাদের হারানো অধিকার।

এই অধিকার আমরা পাইনি। তার বদলে পেয়েছি বুলেট। পচিশে মার্চ মধ্যরাতে অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে গেছে, চারদিকে কামান আর ট্যাঙ্কের গর্জন। অসহায় মানুষের ভীত আর্তনাদ। রক্তে ঢাকা শহর ভেসে গেছে। সারা বাংলাদেশ ভেসে গেছে। আর সেই রক্তের স্রোতে ভাসমান স্তুপীকৃত লাশ। শিশু-নারী-বৃদ্ধ-যুবকের মৃতদেহ এই লক্ষ মানুষের মৃতদেহের স্তুপের নীচে ইয়াহিয়া চাপা দিতে চেয়েছে বাঙালীর আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আমার পিতার সাধের গোলার ধান পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। আমার মাকে দিয়েছে এক-বুক হাহাকার উপহার। গত ২রা জুন তারিখে আমার কৈশোর আর যৌবনের হাজারো স্বপ্নমাখা ঢাকা শহর ছেড়ে যেদিন মুক্তাঞ্চলের দিকে পা বাড়াই, সসিদন জ্যৈষ্ঠের বাংলার তপ্ত প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে অশ্রুসজল চোখে বলেছি, মাগো, আবার যেন তোর কোলে ফিরে আসতে পারি। ফিরে আসতে পারি স্বাধীন বাংলার পতাকাশোভিত তোর ছায়া-সুনিবিড় নীড়ে। খুনী ইয়াহিয়ার দস্যু সেনাবাহিনী আমার চোখ থেকে স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে, আমার রক্তে। কিন্তু সে আমার মৃত্যুঞ্জয় কালজয়ী আবহমানের স্বাধিকার-চেতনা হরণ করতে পারেনি। তাই আজ মুক্ত বাংলার বুকে লক্ষ মুক্তিফৌজ প্রস্তুত। আমার একমাত্র সান্তনা, আমি আমার দেশের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিফৌজের পাশে রয়েছে। যদি মরতে হয় স্বাধীনতার জন্য মরবো, যদি বাঁচতে হয় স্বাধীন জাতির গৌরব ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচবো।

চৌদ্দই আগষ্টের কথা বলছিলাম। এই দিনটি পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু গত ২৫শে মার্চ বিশ্বাসঘাতক ইয়াহিয়া মধ্যরাতের বর্বরতায় যে পাকিস্তানকে হত্যা করেছে, তার আবার স্বাধীনতা-দিবস কি? বাঙালীর স্বাধীনতা স্বাধীন বাংলার স্বাধীনতা। এই স্বাধীন বাংলার স্বাধীনতা দিবস আমরা পালন করবো ঢাকায়, রাজপথ থেকে ইয়াহিয়ার দস্যুচক্রের রক্তচিহ্ন মুছে, শিশুঘাতী নারীঘাতী বর্বরতার শেষচিহ্ন লুপ্ত করে স্বাধিকার-চেতনার নতুন উৎসবে মুখর হবে ঢাকা, উদ্ভাসিত হবে সারা বাংলাদেশ। বিশ্বাস করুন, এই প্রত্যয় নিয়ে আমি বেঁচে আছি। আমার বিশ্বাস বাঙালীমাত্রেই এই বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছেন।

চৌদ্দই আগষ্ট আমারও স্বাধীনতা দিবস হতে পারতো। কিন্তু তাকে হতে দেয়া হয়নি। যা হতে পারতো আমার প্রাণের, ধানের, গানের, সৌরভ, তাকে করা হয়েছে আমাকে দমানোর-নির্মমভাবে দমনের হাতিয়ার। সেই হাতিয়ার আজ ভেঙে গেছে। তাই চৌদ্দই আগষ্ট আজ সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর জীবনে মৃত আর এই একটি

দিবসের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে নব-জন্মগ্রহণ করেছে গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন বাংলা। বঙ্গবন্ধু যার নেতা। আমি, আপনি সকল বাঙালী যে স্বাধীনতার অগ্নিরথের আরোহী।

পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোতে বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকার, রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনায় সমঅংশীদারিতু দেয়ার কোন ইচ্ছা ছিল না করাচী ও ইসলামাবাদের শাসক চক্রের। তারা চেয়েছে বাংলাদেশে একটি অর্থনৈতিক কলোনী প্রতিষ্ঠা করতে। আর এই কলোনী শাসনের জন্য চেয়েছে বাঙালীর উপর একচ্ছত্র রাজনৈতিক প্রভুত্ব। সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশ পশ্চিম পাকিস্তানের ততোধিক সংখ্যালঘু একটি আমলাতান্ত্রিক সামরিকচক্র গত তেইশ বছর বাংলাদেশকে শাসন করেছে, তাদের অনুগৃহীত তেইশটি পরিবার বাংলাদেশেকে যথেচ্ছ শোষণ করেছে, তাদের পণ্যের একচেটিয়া বাজার করে রেখেছে। আজকাল পাশ্চাত্যের কোন কোন খ্যাতনামা রাজনৈতিক ভাষ্যকার সম্পূর্ণ দক্ষিণ আফ্রিকা ও রোডেশিয়ার অশ্বেতাঙ্গদের উপর মুষ্টিমেয় শ্বেতাঙ্গের শাসনের অনুরূপ। পিণ্ডির শাসকচক্র ও প্রিটোরিয়ার শাসকচক্রের ফ্যাসিস্ট, অগণতান্ত্রিক ও মানবতাদ্রোহী ভূমিকার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। বাঙালীর ভাষা, বাংলাদেশের সংস্কৃতি-এক কথায় যা কিছু বাঙালীর জাতীয় চেতনার মহত্তম প্রকাশ, ১৯৪৮ সাল থেকে তাকে বার বার ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছে, এই একটিমাত্র লক্ষ্য থেকে। এবং সেই লক্ষ্য হল বাঙালীর রাজনৈতিক অধিকার হরণ। বাংলাদেশে পিণ্ডির একচ্ছত্র রাজনৈতিক প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠা।

এই প্রভূত্বের বিরুদ্ধে, এই নির্মম শোষণ আর শাসনের বিরুদ্ধে যিনিই কথা বলেছেন, বাংলাদেশের বাঙালীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, করাচী এবং পিণ্ডির শাসকচক্রের চোখে তিনিই হয়েছেন দেশদ্রোহী। বৃটিশ আমলের আমলা গোলাম মোহাম্মদ শেরে বাংলা ফজলুল হকের মত বরেণ্য নেতাকে বলেছেন দেশদ্রোহী, তার বিচার করতে চেয়েছেন। মীরজাফরের বংশধর ইস্কান্দার মীর্জা হুমকি দিয়েছেন, তিনি গুলি করে মারবেন বয়োবৃদ্ধ নেতা মওলানা ভাসানীকে। ইংরাজ আজলের পা-চাটা সিপাই আইয়ুবের চক্রান্তে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দেশের বাইরে সুদূর বৈরুতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হয়েছে। আজ আইয়ুবের বিশ্বাসঘাতক দক্ষিণ হস্ত ইয়াহিয়ার চক্রান্তে প্রাণপ্রিয় মুজিব ভাই রাষ্ট্রদ্রোহিতার মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত। চলছে তার প্রাণ হননের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র।

বাংলাদেশের এমন একজন বরেণ্য নেতা নেই, যিনি পিণ্ডির প্রাসাদ-চক্রীদের কাছ থেকে দেশদ্রোহী আখ্যা পাননি, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হননি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অধিকার এবং স্বাধিকারের দাবি যিনিই করেছেন, তিনি অভিযুক্ত হয়েছেন রাষ্ট্রদ্রোহীতার দায়ে। পিণ্ডির এই নির্মম পীড়ন-চিহ্ন আজ যারা বাংলাদেশের শরীরে। ১৯৪৭ সালের পর এমন একটি বছর নেই, যে বছর বাংলাদেশে রক্ত ঝরেনি, মায়ের বুক খালি হয়নি, সন্তানহারা বাপের বুকফাটা আর্তনাদ বাংলাদেশে আকাশ বিদীর্ণ হয়নি। বাংলাদেশে একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখ কি একটি? ১৭ই মার্চ, ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ১৭ই সেপ্টেম্বর, ৭ই জুন, ২০ শে জানুয়ারি, ২৫ শে মার্চ কত রক্তাক্ত তাখির আর এই তারিখের বীভৎস বর্বরতার কথা বলবো? সবশেষের তারিখ এই ২৫ শে মার্চ তারিখ। ছাত্র-যুবক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ব্যবসায়ী মজুর, ঘুমন্ত বস্তিবাসী নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষকে অকাতরে হত্যা করা হল একটিমাত্র উদ্দেশ্যে, এবং তা হল বাঙালীর স্বাধিকার হরণ।

তাই বাংলাদেশ আজ বিদ্রোহী। স্বাধীনতার রক্তপতাকার নিচে জমায়েত হয়েছি আমরা কোটি কোটি বাঙালী। আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালীর প্রিয় মুজিব ভাই। এই একটি নাম আজ সাড়ে সাত কোটি মানুষের সংগ্রামী প্রেরণা। বাঙালীর স্বাধিকার চেতনার সঙ্গে এই একটি সংগ্রামী মানুষকেও হত্যার জঘন্য ষড়যন্ত্র চলছে পিণ্ডির খুনী চক্রীদের মধ্যে।

আমি সূর্যসম্ভাবনার বিশ্বাসী। বুড়িগঙ্গার পলিমাটিতে তৈরি নতুন জীবন সম্ভাবনাতেও আমি আস্থাবান। এত রক্ত আমরা দিয়েছি, এই রক্তপিচ্ছিল পরে স্বাধীনতার সূর্যোদয় অবশ্যম্ভাবী।

আমরা আবার ফিরবো ঢাকায়। আমাদের নতুন স্বাধীনতা-দিবসে উৎসব হবে। প্রিয় পরিজনের সঙ্গে মিলিত হয়ে সেই উৎসব দিবসটি পালনের জন্য আমি অপেক্ষা করছি। আমি জানি, আমার স্বপ্ন, আমার প্রতীক্ষা সফল হবেই।

(আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত)

Scroll to Top