মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের কবিতা

মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের কবিতা

 

১১ জুন, ১৯৭১

পচিশে মার্চের রাত্রির সুপ্তি থেকে সমগ্র বাংলাদেশ জেগে উঠেছে। মধ্যরাতের দুঃস্বপ্নে অকস্মাৎ কেদে উঠেছিল ঢাকা নগরী। সে কান্না মায়ের জঠর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নবতর জন্মলাভের কান্না। বিশ্বাসঘাতকতার খোলস ছেড়ে নতুন সূর্যোদয়ের মতই স্বাধীন বাংলা পূর্বদিগন্তে উদ্ভাসিত হয়েছে। তার মুক্ত আলোকচ্ছটা সূর্যকরের মতই সত্য আর স্বচ্ছ।

সুজলা সুফলা বাংলা আজ বিশ্বের বিস্ময়ে পরিণত কৃষাণের লাঙ্গল রূপান্তরিত হয়েছে সংগ্রামী হাতিয়ারে, শ্রমিক তার হাতুড়ি ছুড়ে দিয়েছে গ্রেনেডের মত, দেশের অগণিত জনগণ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতার পোষ্টার লিখছে। এ কোন বাংলাদেশ। এই অচিন্তনীয় বাংলার রূপ কি পৃথিবীর মানুষ কখনও দেখেছিল? হয়ত দেখেনি, কিন্তু বাংলার কবিতার চিরকালীন আবহমান বাংলাকে অনুভব করেছেন এই বিস্ময়ময় রূপের মধ্যে। তাই বাংলার রণক্ষেত্রে আজ তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা আবৃত্তি করেন রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ এবং তাদের দেশের একান্ত প্রিয় কবিদের কাব্য।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের একদিকে হিংস্র বন্য পশুদের নির্মম অত্যাচারের যথাযোগ্য প্রত্যুত্তর, অন্যদিকে স্বদেশের প্রতি গভীর আবেগময় ভালবাসা। এই ভালাবাসার প্রতিভাস ফুটে উঠেছে এ দেশের কবির সৃষ্টিতে। মসি এখানে অসির সহযোগী। বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনগণ জীবনানন্দের অনুভবে একান্ত হয়ে উচ্চারণ করেনঃ “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুজিতে যাই না আর।“

ভাষাই সম্ভবত বাঙালির চেতনার উৎসমুখ। নদীর স্রোতের মত অগণিত কাব্যের প্রবাহে হৃদয় ভাসিয়ে এদেশের মানুষ আত্মশুদ্ধ হন। পৃথিবীতে একমাত্র বাংলাদেশেই সম্ভব ভাষা ও ভাবের আত্মীয়তার মধ্যে নিজেদের অস্তিত্বের মুক্তি আবিষ্কার। এ জন্যেই একুশে ফেব্রুয়ারি শুধু ভাষার আন্দোলন নয়; একুশে ফেব্রুয়ারি আজকের স্বাধীনতা-বাসনার প্রথম প্রজ্জ্বলন।

দেশের প্রতি কবিদের আত্মনিবেদনে দেশের মানুষ সমান অংশীদার। তাই এদেশের মানুষের কাছে একজন সৈনিক এক একজন কবি পাশাপাশি পথ চলেন। “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালেবাসি- এ কেবল জাতির সঙ্গীত নয়, জাতির হৃদয়-সঙ্গীত। অন্তরের প্রতি প্রান্তে স্বদেশের মাটির প্রতি কবির যে সংবেদন, মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের প্রতিটি বুলেটে সেই চিরন্তন সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চান। আর তাই অকুতোভয় বাঙালী সৈনিকের কাছে মৃত্যুকেও মৃত মনে হয়, তুচ্ছ মনে হয়।

বাংলার জাতীয় জাগরণে জসীম উদ্দীন কেবল কবি নন, তিনি সংগ্রামের সৈনিক ও বটে। মানুষের প্রতি অপরিসীম সহানুভূতি তাকে নিয়ে এসেছে সংগ্রামী জনতার পুরোভাগে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎসর্গ করে তাই তিনি বলেনঃ

‘সেনাবাহিনীর অশ্বের চড়িয়া

দম্ভ-স্ফীত ত্রাস,

কামান গোলার বুলেটের জোরে

হানে বিষাক্তা শ্বাস।

তোমার হুকুকে তুচ্ছ করিয়া

শাসন ত্রাসন ভয়

আমরা বাঙালী মৃত্যুর পথে

চলেছি আনিতে জয়।’

আমাদের স্বাধীনতার মূল উদ্দীপনা আহৃত হয়েছে দেশের প্রতি উৎসারিত মমত্ববোধ থেকে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, মুক্তিযুদ্ধের রণক্ষেত্রেও এই স্বদেশপ্রীতিই হচ্ছে আসল হাতিয়ার। দেশকে ভালোবাসার অপরিমেয় আগ্রহ এক নতুন রণশক্তির সৃষ্টি করেছে যে মানবিক মূল্যবোধহীন বর্বর পশুশক্তির বিরুদ্ধে প্রত্যুত্তর দিতে সক্ষম। এখানেই বাংলাদেশের কবিরা হয়ে উঠেছে মুক্তিসেনার পরম সহায়ক। যুদ্ধ এক ধরনের হিংস্রতা সন্দেহ নেই, কিন্তু জীবন দেয়া-নেয়ার গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টিতে মুক্তিবাহিনীর প্রত্যেকটি সৈনিকের মুখে যে নির্ভীক সাহসিকতার ঔজ্জ্বল্য প্রকাশমান তার প্রেরণা বাংলা মায়ের মুখ। দেশ আর দেশের মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসই যেখানে অস্ত্র, সেখানে পশুশক্তির পরাজয় অনিবার্য। হাসান হাফিজুর রহমান এমনিতর অস্ত্রই আবিষ্কার করেছেন। যা জনগণের চোখের দৃষ্টি আর বুকের ভাষা থেকে উৎসারিত।

‘অনাদি অটল দুর্গজয়ী অস্ত্র পাবে কোথায়?

মোহাচ্ছন্ন চোখে তোমার পড়ে না কিছুই।

দ্যাখো না লক্ষ্য কোটি তীব্র চোখ ভিন্ন আলো ফেলে,

কণ্ঠ তাদের আকাশ বাতাস চেরে?

অস্ত্র আমার তাদের চোখ

অস্ত্র আমার কোটি কণ্ঠের ভাষা’।

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পরিণতি আজ অতি স্পষ্ট। ইতিহাসের অনিবার্য গতিতেই আসন্ন হয়েছে এদেশের স্বাধীনতা। মানুষ মারার জন্যে বুলেটের সাথে অমানবিক জিঘাংসার প্রবৃত্তি থাকা প্রয়োজন, কিন্তু পশু হত্যার জন্যেই চাই মানবিক দৃঢ়বদ্ধ চেতনা। এ বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমগ্র জাতি এখন রক্তক্ষয়ী আপোষহীন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। হাজার মাইল দূর থেকে নিয়ে আসা ভাড়াটে হানাদল বিপর্যস্ত ও পর্যুদস্ত হয়ে উঠেছে। কোন নৈতিক মনোবলশূন্য সামরিক শক্তি যত বিশালই হোক না কেন, আত্মিক বলে বলীয়ান নিরস্ত্র মানুষের শক্তিও তার চেয়ে কম নয়। এহেন মনোবলের বোধ পাকিস্তানের শূন্যগর্ভ বুলিতে কোনকালেই জাগ্রত করা সম্ভব নয়, অন্যদিকে বাংলাদেশের কবিরা বাঙালীর আত্মিক প্রেরণার সুদৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে শত্রুর মোকাবিলা করছে। রক্তের ফিনকিতে লাল হয়ে যদিও বাংলাদেশ ধুয়ে যাচ্ছে, তবু মহান মুক্তিসেনারা আজ মৃত্যুভয়ে ভীত নয়। তাদের মনের নির্ভীক প্রতিরূপটিকে ব্যক্ত করে এদেশের কবি বলেনঃ

মৃত্যুকেও মৃত মনে হয় আজকাল, কারণ মৃত্যুতে

মোমবাতির শিখাটি নড়ে না,

শোকধ্বনির মধ্যে গভীর আনন্দে খোল করতাল বাজে

অন্ধকারে আলো ওঠে জ্বলে

স্বপ্লের রং গুড়ো হলে কারা তবু আঁকতে চায় ছবি

বারুদের পোড়া গন্ধ শুঁকে

স্বদেশের ঘ্রাণ পায়, প্রাণে নেয় আশ্বাসের বায়ু

দুঃখ ক্লান্তি ভীতি নেই, যেহেতু তাদের

প্রত্যেক দুঃখের সঙ্গে আনন্দ ঘুমায় অবিরত,

যেহেতু এখন

মায়ের জঠরে কাঁদে বাংলাদেশ নবতর জন্মের পুলকে।’

ইতিহাসের অমোঘ ধারাকে লংঘন করার সাধ্য পাশব শক্তির প্রতিভূ ইয়াহিয়া খানের নেই। বাংলাদেশ এখন সেই মহাজাগতিক সত্যের ধারায় স্নাত হয়ে মুক্ত সত্তার প্রতীক্ষায় দিন গুণছে। এ পৃথিবীর রণরক্ত সফলতা সত্য, কিন্তু শেষ সত্য নয়’- জীবনানন্দের এই চিরন্তন বাণী মিথ্যার মুখোশ উন্মোচন করে স্বাধীনতা পরম সত্যের মাঝখানে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করবে। সেই অলখ অরুণোদয়ের প্রতীক্ষায় আমরা নিদ্রাহীন, ক্লান্তিহীন। জীবনকে ভালবাসি বলেই আমরা বরণ করি মৃত্যুকে।

(কামাল মাহবুব’ ছন্দনামে মাহবুব তালুকদার রচিত)

Scroll to Top