বাংলা সংবাদ

শিরোনাম সুত্র তারিখ
৪। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বাংলা ও ইংরেজী সংবাদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-

এর দলিলপত্র

২৬ মে-৫ জুন, ১৯৭১

 

বাংলা সংবাদ

২৬-৫-৭১

        (১) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন,স্বাধীনতা ও

সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির মধ্যেই রয়েছে বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার চাবিকাঠি।

(২) ওয়ার অন ওয়ান্ট প্রতিষ্ঠান প্রধান ও বৃটিশ এম-পি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেছেন।

(৩) বুদাপেষ্টের শান্তি সম্মেলন বাংলাদেশে পাকিস্তানী হামলার নিন্দা করেছে।

(৪) মুক্তিফৌজ গানবোট দখল করেছে, কালভার্ট উড়িয়ে দিয়েছে, পাক ফাঁড়ি উড়িয়ে দিয়েছে।

(৫) আজ বাংলাদেশের সর্বত্র বিদ্রোহী কবি নজরুলের জন্মজয়ন্তী পালিত হচ্ছে।

(৬) বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী নিউইয়র্ক পৌছেছেন।

(৭) পাকিস্তান বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের প্রধান উ থান্টের কাছে বাংলাদেশের বৌদ্ধহত্যার কাহিনী

জানিয়েছেন।

 

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীন ও সার্বভৌম সত্তা স্বীকার করে নেওয়ায় মধ্যে নিহিত রয়েছে বাংলাদেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসার নিশ্চয়তা। তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে, জাতিসংঘ বাংলাদেশ থেকে পাক সৈন্য সরিয়ে নিতে পাকিস্তান সরকারের উপর প্রভাব বিস্তার করবে।

ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের জনৈক বিশেষ প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান বাংলাদেশ মনোভাব ব্যক্ত করেছেন।

ভারতে আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশ শরণার্থীদের সাহায্য দানের জন্য বিশ্ব সরকারসমূহের প্রতি জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল যে আবেদন জানিয়েছেন সে সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন,বিরাট সংখ্যক নির্যাতিত ও নিগৃহীত মানুষ যে পাক-দস্যুদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে গিয়েছে উ থান্টের আবেদনে তার স্বীকৃতি রয়েছে। সেক্রেটারী জেনারেলের বিবৃতি থেকে এও প্রতীয়মান হয়, কি নিদারুন পরিস্থিতিতে মানুষ জন্ম-জন্মান্তরের বাড়িঘর ছেড়ে বিদেশে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম আশা প্রকাশ করে বলেন যে উ থান্ট বাংলাদেশে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব নেবেন যে পরিবেশে দেশত্যাগী শরণার্থীরা পূর্ণ মর্যাদায় ও নিরাপত্তায় আবার দেশে ফিরে আসতে পারবেন। উক্ত সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার এ বক্তব্যের দ্বারা আমি এ কথাই বোঝাতে চাচ্ছি যে জাতিসংঘ পাকিস্তান সরকারের উপর এমন একটা চাপ সৃষ্টি করবে যে চাপের মুখে বাংলাদেশ থেকে

পাক হানাদার বাহিনী প্রত্যাহার করা হবে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হবে। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হওয়ার মধ্যেই বাংলাদেশে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা

ফিরে আসার সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে। তিনি বলেন, শুধু সে অবস্থাতেই দেশত্যাগী লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু স্বদেশে ফিরে আসতে পারবে।

বুদাপেষ্ট শান্তি সম্মেলনে যোগদানকারী ৫৫টি দেশের ১২৫ জন প্রতিনিধি একটি বিশেষ আবেদন প্রচার করেছেন। প্রতিনিধিদের মধ্যে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আইনজীবী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আফ্রো-এশীয় দেশসমূহের মুক্তি আন্দোলনের এবং গোষ্ঠী-নিরপেক্ষ দেশসমূহের নেতৃবৃন্দ রয়েছেন।

আবেদনে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যদানের জন্য এবং তারা যাতে মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারেন সেই অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বিশ্বের সরকারসমূহের ও জনগণের প্রতি অনুরোধ জানান হয়েছে। তারা বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য পাকিস্তান সামরিক শাসক-চক্রের কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা করেছেন। বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্খার প্রতি মর্যাদা প্রদর্শনের জন্য তারা পাক সামরিক শাসকচক্রের প্রতি আহবান জানান। তারা সিয়াটো-সেন্টো জোটের মার্কিন এবং অন্যান্য সদস্যরা যাতে পাকিস্তানের সামরিক চক্রকে সাহায্য দেয়া বন্ধ করেন তার জন্যও দাবী জানিয়েছেন। বুদাপেস্ট শান্তি সম্মেলনে জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব এম. এ. সামাদ বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি বর্তমানে লণ্ডনের পথে রয়েছেন বলে অনুমান করা হচ্ছে।

বিলেতের War on Want প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মিঃ ডোনাল্ড চেসওয়ার্থ এবং শ্রমিক দলের পার্লামেন্ট সদস্য মিঃ মাইকেল বার্নস গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠক প্রায় তিন ঘণ্টা কাল স্থায়ী হয়। এই বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির প্রশ্নে বৃটিশ সরকারের মনোভাব সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান বলতে বৃটিশ পার্লামেন্ট কি বোঝাতে চাইছেন সে সম্পর্কে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বৃটিশ এম, পি-র কাছ থেকে বিশদ ব্যাখ্য দাবী করে বলে জানা গেছে। বৃটিশ নেতা আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খার বাস্তবায়নকেই তাঁরা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান বলে মনে করেন। বাংলাদেশ থেকে বাঙালীদের তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে একটা শাসন চাপিয়ে দেওয়ার নাম রাজনৈতিক সমাধান নয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

মুক্তিবাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় সদর দফতর থেকে পাওয়া এক খবরে জানা গেছে যে, মুক্তিফৌজ এক প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর পাকিস্তানী সেনাদের একখানা গানবোট দখল করে নিয়েছে। গানবোটযোগে খানসেনারা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল। গানবোটের আরোহী সব ক’জন খানসেনাই পানিতে ডুবে মারা গেছে।

মুক্তিবাহিনী জোয়ানেরা বরিশালে একটি থানা আক্রমণ করেন এবং বাঙ্গালীর দুশমন খানসেনাদের কয়েকজন স্থানীয় দোসরকেও হত্যা করেন।

রংপুর সেক্টরে পাকিস্তানী সৈন্যদের একটি দল ধরলা অতিক্রমের চেষ্টা করলে মুক্তিফৌজ তাদেরকে বাধা দেয়। সংঘর্ষকালে বেশ কয়েকজন খানসেনা নদীতে ডুবে মারা যায়।

রাজশাহীর কাছে একটি কালভার্টে মুচক্তিফৌজের স্থাপিত মাইন বিস্ফোরিত হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি জীপ ধ্বংস হয়েছে। জীপের আরোহীরা গুরুতর আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।

সিলেট সেক্টরে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের একটি কনভয়ের উপর চোরা-গোপ্তা আক্রমণ চালায়। এতে শত্রুপক্ষের ৭ খানা যানবাহন ধ্বংস হয়। বিয়ানীবাজার এবং বরলেখায় মুক্তিফৌজ খানসেনাদের ১৭ জন স্থানীয় দালালকে হত্যা করেছে বলে সংবাদ পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি কুমিল্লার কসবা অঞ্চলে বাংলাদেশ মুক্তিফৌজ একটি পাক-হানাদার বাহিনীর উপর হামলা  চালায় এবং তাদের হটিয়ে দেয়।

এই অঞ্চলে মোন্দেভাগ নামক এক জায়গায় পাক-হানাদারদের একটি ট্রলি বোঝাই অস্ত্র আর খাদ্যদ্রব্য যাচ্ছিল। মুক্তিফৌজ সেটি আক্রমণ করে পুড়িয়ে দিয়েছেন। বল্লবপুরে পাক-ঘাঁটির উপর হঠাৎ আক্রমণ করে মুক্তিফৌজ দু’জন প্রহরীকে হত্যা করেছেন। কাঁঠালবাড়িয়াতে মুক্তিফৌজের হামলায় পাক-বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন ও কয়েকজন পাক-হানাদার খতম হয়েছে। ময়মনসিংহ এলাকার শ্রীবর্দীতে মুক্তিফৌজ একটি পাকা সেতু উড়িয়ে দিয়েছেন।

সিলেট সেক্টরে দুটি পাক-ঘাঁটি মুক্তিফৌজ জ্বালিয়ে দিয়েছেন। এই ঘাঁটি দুটির নাম জামকান্দি ও লালাপুঞ্জি। কুমিল্লায় বিবিরবাজারে মুক্তিফৌজ মাইন ফেলে পাক-হানাদারদের একটি ট্রাক বিধ্বস্ত করেন।  হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি। হিলি আর পাচবিবির মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা আমাদের মুক্তিফৌজ বিপর্যস্ত করে দিয়েছেন।

চট্টগ্রাম শহর ও বন্দর এলাকায় যুক্তিসংগ্রামরত বাঙালী ছাত্ররা পাকিস্তানী বর্বর সৈন্যদের হুশিয়ার করে  দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়েছে। পোস্টারের ভাষা হচ্ছে, ইয়াহিয়ার সেনাদের খতম কর- ওদের খতম কর- খতম কর। অবিলম্বে বাংলাদেশ ছেড়ে না গেলে হানাদার সৈনিকদের সবাইকে খতম করা হবে বলে হুঁশিয়ারি করে দেওয়া হয়েছে ।

আজ বাংলাদেশের সর্বত্র বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৭২তম জন্মজয়ন্তী পালিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান আয়োজন করেছে আলোচনা সভা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। আজকের সান্ধ্য অধিবেশনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও নজরুলের উপর একটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে।

পাকিস্তান বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ এবং বিশ্ব বৌদ্ধ ফেলোশিপের পাকিস্তান আঞ্চলিক শাখার সভাপতি মিঃ জ্যোতিপাল মহাথেরো জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্টের কাছে বাংলাদেশে পাক সৈন্য কর্তৃক বৌদ্ধ নিধনযজ্ঞের সংবাদ জানিয়ে একটা তারবার্তা পাঠিয়েছেন। তারবার্তায় তিনি জাতিসংঘের সেক্রেটারী জেনারেলকে জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশে পাক সৈন্যরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগণকে নির্বিচারে হত্যা করছে। এই হত্যাকাণ্ড থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও বাদ যাচ্ছে না। মহাথেরো জানিয়েছেন, বৌদ্ধদের গ্রামগুলো একের পর এক জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, মন্দিরগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। মহাথেরো বাংলাদেশের বৌদ্ধদের রক্ষা করার জন্য উ থান্টকে অনুরোধ জানিয়েছেন।

Scroll to Top