“বাংলাদেশ ফাইটস ফর ফ্রিডম”-বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন

<৪,৩৩,৫৫-৬০>

অনুবাদকঃ শিরোনামহীন-১

শিরোনাম সূত্র তারিখ
৩৩। “বাংলাদেশ ফাইটস ফর ফ্রিডম”-বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন

 

বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি প্রকাশিত পুস্তিকা ৮মে, ১৯৭১

 

বাংলাদেশ ফাইটস ফর ফ্রিডম

প্রকাশনায় – বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি, যুক্তরাজ্য

৬৮এ স্ট্রেথাম হাই রোড, লন্ডন, এসডব্লিউ ১৬

ফোন – ০১-৭৬৯-৪৬৯০

ভূমিকা

এই পুস্তিকা খুব সংক্ষিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চালানো রাজনৈতিক দমন ও অর্থনৈতিক শোষণ সম্পর্কে ধারণা দেবে।

১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাতে শুরু হওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক নজিরবিহীন গণহত্যার কারণে ধর্মীয় সৌহার্দ্যের ভিত্তিতে এক হওয়া দু’টি অংশ আজ সম্পূর্ণ পৃথক।

এই গণহত্যা থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এই অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক দমন বন্ধ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করা। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনতা আজ সেই সংগ্রামে রত।

এ. এস. চৌধুরী

উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিচারক, হাই কোর্ট ঢাকা

৮ মে, ১৯৭১

 

বাংলাদেশ ফাইটস ফর ফ্রিডম

১৯৪৭ সালে মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভেতর পাকিস্তানের জন্ম হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের ভেতরে থেকেই পাকিস্তানের দু’টি অংশেরর উৎপত্তি এবং শুরু থেকেই এর ইতিহাস ছিল প্রাদেশিক অসন্তোষ দ্বারা ত্রুটিপূর্ণ।

“সেকেন্ড ফ্লাড অভ ইস্ট পাকিস্তান” শিরোনামে দ্য সানডে টাইমস, লন্ডনে বলা হয়েছে: “পাকিস্তানের বর্তমান অশান্তি মূলত ব্রিটিশ ভারত পৃথকীকরণ প্রক্রিয়ার একটি যৌক্তিক সমাপ্তি, যা ২৫ বছর আগেই শুরু হয়েছিল। সম্পূর্ণ পৃথক এবং বিশেষ করে একটি মুসলিম রাষ্ট্র তৈরির ওপর জোর দিয়ে মরহুম জনাব জিন্নাহ ও তার মুসমিল লিগের সহকর্মীরা শুধুমাত্র মুসলিম ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে হু’টি জাতির জন্ম দিয়েছিলেন, যা ছিল সংস্কৃতি, ভাষা এবং হাজার হাজার মাইল শত্রুতাপূর্ণ ভারতীয় এলাকা দ্বারা সম্পূর্ণ আলাদা”।

সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মার্কিন প্রফেসর, এডওয়ার্ড এস. মেসন বলেছেন, “পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা অনিবার্য। একটি অবিভক্ত পাকিস্তান কাঠামোর ভেতরে থেকে অর্থনৈতিক স্বায়ত্ত্বশাসনের নিমিত্তে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা অনিবার্যভাবেই পূর্ব পাকিস্তানি জনগণকে গণহারে হত্যার মাধ্যমে এমন একটি আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছে, যা আজ না হোক কাল একটি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্ম দেবে – “বাংলাদেশ” এখন কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র”। সংক্ষেপে পত্রিকাটি মূলত পাকিস্তানের ইতিহাসকেই তুলে ধরে ও সাংস্কৃতিক, ভাষাগত এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করে এবং দু’টি পক্ষের অর্থনীতি ও রাজনীতিই আসলে বর্তমান সংঘর্ষের প্রধান কারণ বলে বিবেচনা করে।

পাকিস্তান মূলত ধর্মীয় মনোভাবের ওপর ভিত্তি করেই গঠিত হয়েছিল এবং গঠনের পর সেই মনোভাবকে জিইয়ে রাখার চেষ্টাই করা হচ্ছিল। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে এক হাজার মাইল ভারতীয় অঞ্চল ছড়িয়ে রয়েছে। উভয়েই মুসলিম হলেও এরা অনেকটা পর্তুগাল আর পোল্যান্ডের মতই। ১৯৪৯ সালেই রিচার্ড সিমন্ডস তাঁর “দ্য মেকিং অভ পাকিস্তান’ বইতে তাঁর পর্যবেক্ষণ লিখে গিয়েছিলেন, “পাকিস্তানের ভেতরে পূর্ব বাংলার অঞ্চলটিতেই নীরিক্ষা করা সবথেকে কম সহজ, অথচ এর ভবিষ্যত নির্ধারণ করাটাই সবচেয়ে কঠিন”। “পশ্চিম হল খুব শুষ্ক একটি জায়গা, যেখানে চওড়া চোয়াল, পাগড়ি আর ঢোলা পায়জামাওয়ালা লম্বা পুরুষদের প্রধান চলাচলের বাহন হল উট, আর পূর্বাঞ্চলে বর্ষাকালে গ্রাম থেকে গ্রামে আর বাড়ি থেকে বাড়িতে ছোটখাটো, উজ্জ্বল রঙের চেক লুঙ্গিপরা পুরুষেরা চলাফেরা করে নৌকায়। পশ্চিম পাকিস্তান মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দিকে সংযুক্ত আর পূর্ব পাকিস্তান অনিবার্যভাবেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্তর্গত”। বাঙালিদের ভাষা, পোশাকআশাক, খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনধারণ প্রণালি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা এবং ইকোনমিস্ট অভ লন্ডনের পর্যবেক্ষণটিই এক্ষেত্রে অনেকখানি সঠিক – “পূর্ব পাকিস্তান কথা বলে বাংলায়, উর্দু থেকে তা আলাদা হওয়া ছাড়াও এখানকার অধিবাসীরা এই উপমহাদেশের সবচাইতে স্পষ্টভাষী, সবচাইতে রাজনীতিসচেতন এবং চিররসবোধসম্পন্ন মানুষদের দলের অন্তর্ভূক্ত”।

অতএব, এই বিষয়গুলোর ভিত্তিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তানের দুই অংশ, পূর্ব আর পশ্চিম মূলত জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে গঠিত হয়নি, বরং ধর্মীয় মনোভাবের ভিত্তিতে হয়েছে। পাকিস্তানের জন্ম থেকেই পশ্চিম পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী ভেবেছিল যে, যতদিন পর্যন্ত মানুষকে এই মনোভাবের প্রতি সোচ্চার রাখা সম্ভব হবে, ততদিন পর্যন্ত বাঙালিকে শোষণ করার একটি ভালো সুযোগ পাওয়া যাবে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে শোষণ ও স্বৈরাচারী নিয়ম-শৃংখলার বীজ বুনে দিয়ে গিয়েছিলেন তথাকথিত জাতির জনক জনাব জিন্নাহ। জনাব জিন্নাহ হয়েছিলেন প্রথম গভর্নর জেনারেল এবং একই সাথে পরবর্তীতে রাষ্ট্রের অন্যান্য উচ্চ পদসমূহেরও দায়িত্বে ছিলেন– ক্ষমতায় থাকা মুসলিম লিগ পার্টির সভাপতিত্ব এবং সমবায়ী পরিষদের সভাপতিত্ব। যেকোন উপায়েই হোক, একটি গণতান্ত্রিক দেশের ইতিহাসে এ এক নজিরবিহীন ঘটনা। “রোমান পরিবারে ২০ শতকের দিকে পিতারা নিজেদের কর্তৃত্ব নিশ্চিত করতে পরিবারে অসন্তোষ তৈরিতেও পিছপা হতেন না, তেমনি পাকিস্তানেও অনিবার্যভাবেই একটি বিশৃংখলা তৈরির পাঁয়তারা চলছিল এবং এই অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমের কারণে আরও অনেক অগণতান্ত্রিক বিষয়াদির সূচনা হওয়া ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার”। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন, জনগণে মতামত ছাড়াই নিজের ইচ্ছেমত নিয়ম জারি করে গিয়েছেন।

১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানের ভাষণে জনাব জিন্নাহ স্পষ্টতই বলেন যে, “পাকিস্তানের একটাই হবে রাষ্ট্রভাষা আর তা হল উর্দু”। এটি ছিল অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক, কারণ পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ কথা বলত বাংলায়, যা ছিল ইন্দো-পাকিস্তান উপমহাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধ একটি ভাষা। তিনি আরও ইংগিত করেন যে, এই ভাষা ষড়যন্ত্রে ইন্ধন যুগিয়েছে “ফিফথ কলামিস্টস”। এই রাজনৈতিক দমনের কারণে খুব শীঘ্রই পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করতে আরম্ভ করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তান এও বুঝে গিয়েছিল যে, বাংলার রাজস্ব আয় ছাড়া তাদের সামরিক অস্ত্রের যোগান ফাঁটা বেলুনের মত চুপসে যাবে। এ কারণেই ‘পাকিস্তান বাঁচাও’, ‘ইসলাম বাঁচাও’ বলে মাতম শুরু হল। ইসলাম কিংবা দেশপ্রেমের একচেটিয়া অধিকার কেবলমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানেরই আছে বলে পূর্ব পাকিস্তানিরা বিশ্বাস করে না। তারা নিজেদের মত করে ইসলামে নতুন মাত্রা যোগ করছে ঠিক যেমনটি করেছিল তুর্কী, মিশরীয়, আলজেরিয়ান আর ফিলিস্তিনিরা।

অর্থনৈতিক শোষণ

হাভার্ড ইউনিভার্সিটির একজন অর্থনীতিবিদ, রবার্ট ডর্ফম্যান, বলেছিলেন, “পাকিস্তানের দু’টি অংশের গড়পরতাজীবনযাত্রার মধ্যকার যে বিশাল ও বিস্তৃত ফারাক, তা আসলে প্রশ্নাতীত। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তান অধ্যুষিত সরকারও স্বীকার করে যে, গড়ে একজন পূর্ব পাকিস্তানি পশ্চিম পাকিস্তানের গড় আয়ের মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ আয় করে এবং অতিরিক্ত দামও তাকে পরিশোধ করতে হয়। আয়ের এই অসমতার জন্য মূলত পশ্চিমাঞ্চলের স্বার্থ থেকে পূর্বাঞ্চলের স্বার্থ আদায়ের জন্য একটি পরিকল্পিত অধীনতাই দায়ী, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান দাবি করে যে বৈদেশিক আদান-প্রদান, যা পূর্ব পাকিস্তানের পাট রপ্তানি থেকে আসে, তা অসমভাবে পশ্চিম পাকিস্তানকেই সুবিধা দিয়ে থাকে, জাতীয় বিনিয়োগের এই বণ্টন আয়ের অসমতাকে বাড়িয়ে দেয় – ওই উচ্চ শুল্কহার এবং আমদানি কোটাসমূহ পশ্চিম পাকিস্তানে মুনাফা ও কর্মসংস্থান বাড়াতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানিদের পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়”। দ্য ইকোনমিস্ট আরও বলে, “আমাদের মতে এই বিষয়গুলোই মূলত মূল্যবৃদ্ধির কারণ”।

১৯৫২ সাল থেকেই পাকিস্তান একটি বৃহৎ বৈদেশিক সাহায্যগ্রহণকারী দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং চীন থেকে, যার বেশিরভাগ অংশই পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পায়নের পেছনে খরচ হয়েছে, আর পূর্ব পাকিস্তানে খুব অল্প সংখ্যক প্রকল্পই হাতে নেয়া হয়েছে, এমনকি সেগুলোর মালিকানাও পশ্চিম পাকিস্তানিদেরই। ১৯৫৯-৬০ সালে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথা পিছু আয় ছিল ৩২% বেশি। পরবর্তী ১০ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানে আয় বৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল ৬২%, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল মাত্র ৪.২%। ফলস্বরূপ, ১৯৬৯-৭০ সালের মধ্যে পূর্বের চেয়ে পশ্চিমে মাথা পিছু আয় ছিল ৬১% বেশি। পূর্ব পাকিস্তানের বৈদেশিক বাণিজ্য আয় পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থ আমদানিতে ব্যবহৃত হয়, বিশেষত শুল্ক, আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং শিল্পসংক্রান্ত লাইসেন্সিং পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পণ্য ক্রয়ে বাধ্য করে, যেগুলো বিশ্ববাজার থেকে আরও স্বল্পদামে সংগ্রহ করা যায়। ১৯৭০ সালের লন্ডন টাইমসের ২০ অক্টোবর সংখ্যায় বলা হয়: এই মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তান চীন থেকে কয়লা সংগ্রহ করে প্রতি টন একদর ১৭২ রুপিতে। এটি পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র স্টিল কারখানার এই বিশাল পরিমাণ লোকসানের অন্যতম বড় একটি কারণ। তা সত্ত্বেও, সীমানা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নিয়ে আসা কয়লা প্রতি টন মাত্র ৫০ রুপি। তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তান তার মূল পণ্যসামগ্রী, মাছ এবং নিম্নমানের পাট পশ্চিমবঙ্গের আগ্রহী ও মুমুর্ষু কারখানাগুলোতে বিক্রি করতে পারত”।

পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের আরেকটি অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক শোষণের মাধ্যম হল পাবলিক বিনিয়োগ ক্ষেত্র। ১৯৫৫-৬৬ -১৯৬৯-৭০ সালে ৩য় পাঁচ বছর মেয়াদী পরিকল্পনায় ৩৬% বৃদ্ধি অর্জন করে, ১৯৫০-৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৬০% সহ কেন্দ্রীয় সরকার উন্নয়ন ব্যয় ২০% কমে গেছে। পূর্ব পাকিস্তান প্রাইভেট শেয়ার বিনিয়োগের আরও কম অংশ পেয়েছে, ২.৫% এরও কম।

পূর্ব পাকিস্তানে ৫ মাস আগের জোয়ারে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রায় ১০ লক্ষ বাঙালি প্রাণ হারিয়েছে। পৃথিবীর কোন শক্তিই প্রাকৃতিক দূর্যোগকে রুখতে পারে না, কিন্তু ত্রাণসামগ্রী বিতরণ কার্যক্রমে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি ক্ষমার অযোগ্য। ১৯৩৭ সালেই সুভাষ চন্দ্র বসু বন্যা প্রতিরোধ, ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নয়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চাষের জমি পুনঃরুদ্ধারের জন্য ছয় লেনের পরিবহন ব্যবস্থা সমৃদ্ধ একটি ২৬০ মাইল লম্বা উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণের পরামর্শ দেন। সেই প্রকল্পসমূহের দায়িত্ব নিয়েছে পারস্পরিক শত্রুতাপূর্ণ ইউরোপ এবং পাকিস্তান ও ভারত। পূর্ব পাকিস্তান ও পূর্ববঙ্গ মিলে এটি করতে না পারার কোন কারণই ছিল না।

এই উপমহাদেশ শক্তিশালী পাহাড় দ্বারা সমৃদ্ধ। এখানে নুড়িপাথরের কোন অভাব নেই। বাঙালিরা কাজ করতে আগ্রহী। এখানে শ্রমের কোন অভাব নেই, কেবল নেতৃত্বের প্রয়োজন। এ শুধু বাঙালিদের পক্ষেই দেয়া সম্ভব, কারণ প্রাচীনকাল থেকে তারা সর্বনাশা সমুদ্র আর অদম্য নদীনালার সাথে বসবাস করে আসছে। প্রস্তাবিত বাঁধটি কেবলমাত্র সমগ্র অঞ্চলের অর্থনীতিকে গতিশীলই করবে না, বরঞ্চ ভবিষ্যতের জন্য দারিদ্র্যপীড়িত বাঙালির মধ্যে আশার আলোও জাগিয়ে তুলবে। সাম্প্রতিককালে ঢাকায় এক পশ্চিমা কুটনীতিক বলেন: “যদি সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে তার শুরুটা হবে এই বাংলায়-ই”। উপকূলীয় বাঁধটিই কেবল পারে এই ধ্বংস ঠেকাতে। আর কিছু পারবে না। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বারবারই বাঙালিদেরকে বলে থাকে যে, এই বাৎসরিক বন্যা, এর ধ্বংসাত্মক জোয়ার এবং খরা – সবই সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা, অথচ পশ্চিমের সাম্প্রতিক ইন্দো অববাহিকা প্রকল্প ওই মরুভূমি এলাকাকে উর্বর এক জমিতে পরিণত করেছে জলাবদ্ধতার সাথে সংগ্রাম করেও।

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ৯০% সদস্যই আসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। সামরিক বাহিনী তত্ত্বাবধানের এই বিপুল খরচ সেখানকার মানুষের ৭৫% সুবিধায় কাজে লাগানো হয়, এত বছর ধরে অবিবেচকের মত এভাবেই পশ্চিম পাকিস্তানের কলহ আর পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনা সংঘটিত হয়ে এসেছে। সেনাবাহিনীর বিনিময়ে বেশিরভাগ স্বার্থত্যাগের এটি একটি অর্থলোভী কর্মপন্থা, যা মূলত কাশ্মিরের মত বাহ্যিক কিছু সমস্যাকে জিইয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা তৈরি করেছে। কোন বাঙালিকে সি-ইন-সি কিংবা সেনাবাহিনীর অফিসের দায়িত্ব না দেয়ার জন্য পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এটি একটি অলিখিত কর্মপন্থা। বিমানবাহিনী কিংবা নৌবাহিনী এবং প্রতিভাবান বাঙালি অফিরসারদেরকে জোরপূর্বক মেজর কিংবা লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে এবং আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে প্রদত্ত পদসমূহে অবসর গ্রহণে বাধ্য করা হয়। মুখ্য সামরিক প্রতিস্থাপনাসহ সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর তিনটি মূল দফতরই পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত, যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের ধ্বংসের জন্য একটি সামরিকভাবে শক্তিশালী পাকিস্তান চেয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানকে দূর্বল করে একে চিরস্থায়ীভাবে উপনিবেশ হিসেবে শাসন করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের এটি ছিল একটি ভয়ংকর উদাহরণ। বাঙালিরা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী না, কথাটি সত্যের উপহাসমাত্র। কারণ হিসেবে বলা যায়, বাংলা সেনাবাহিনী ১৯৬৫ সালে লাহোর সেক্টরে ভারতের বিরুদ্ধে সাহসী যুদ্ধ করেছিল। এমনকি এখনও তারা সুপ্রশিক্ষিত ও সশস্ত্র পাকিস্তানি সেনাদের সাথে কোনরকম অস্ত্র ছাড়াই যুদ্ধ করে যাচ্ছে।

লাহোর চুক্তি ও ছয় দফা

১৯৬৬ সালে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, শেখ মুজিবুর রহমান একটি ছয় দফা কার্যক্রম তৈরি করেন, যেখানে বিস্তারিত আলোচনা করে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্ত্বশাসনের ডাক দেয়া হয় এবং এটি সর্বপ্রথম উত্থাপিত হয় ১৯৫৩ সালে ঢাকার একটি জনসভায়। এটি মূলত বাংলার অবহেলিত জনগণের মুক্তির জন্য তৈরি হয়েছিল এবং যা মূলত ১৯৪০ সালে মুসলিম লিগের লাহোর চুক্তি, যা পাকিস্তানের জন্মদান করে, তার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। ভারত বিভাজনের ৭ বছর আগে এই চুক্তি পাশ করা হয়। এতে অনুমোদিত হয় যে, পাকিস্তানের মূল প্রদেশসমূহ পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্বশাসন ভোগ করবে। তার দাবির মূল বক্তব্য ছিল একটি যুক্ত্ররাষ্ট্রীয় সংবিধান যা ওই যুক্ত্ররাষ্ট্রীয় সরকারকে কেবল পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষার দায়িত্ব দেবে এবং এমনকি যুক্ত দু’টি রাষ্ট্র তাদের “প্রাদেশিকতা” বাড়াতে পারবে এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের তাদের নিজস্ব চুক্তি তৈরি কর‍্তে পারবে।

১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান বলেন যে, শেখ মুজিবের ছয় দফাকে তিনি আলাদা হয়ে পড়ার হুমকি হিসেবে নিয়েছেন এবং সতর্ক করে দিয়েছেন যে দরকার হলে তিনি সেগুলো মেনে নেয়ার পরিবর্তে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হবেন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন হয়েছিল। তৎক্ষণাৎ শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয় এবং বেশিরভাগ বিদেশি পত্রিকায়ই এ ঘটনা অগ্রাহ্য করা হয়। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে তাঁকে চতুর্থবারের মত গ্রেফতারের এই ঘটনায় বাঙালিরা তাকে শহীদ ভেবেছিল। রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান ও অন্যান্য শাসক গোষ্ঠীর কারসাজিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় মুজিবকে আর ৩৫ জনের সাথে বিচারের আওতায় আনা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তারা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ভারতীয় অনুচরদের সাহায্যে আইয়ুব সরকারের অপসারণে একটি বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র করে। এই অভিযোগের সত্যতার কোন ছিটেফোঁটাও ছিল না এবং প্রমাণের অভাবে মুজিবের পক্ষে অসমাপ্ত অবস্থায় বিচারকার্যের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং কারাগারে গুলি খাওয়া একজন বাদে তিনি ও বাকি সবাইকে মুক্ত করে দেয়া হয়। মুজিব আসলে স্বায়ত্তশাসন নয়, অনৈতিক অপসারণ চাইছেন বলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদেরকে ভুল বুঝিয়ে মুজিব ও তাঁর নেতৃত্বের সম্মানহানি করাই ছিল এই বিচারের উদ্দেশ্য। তা সত্ত্বেও, পাকিস্তান সরকার এই নীল নকশা দারুণভাবে ব্যর্থ হয়। রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান নিজেই এতে অপদস্ত হন।

পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মানসিকতার দু’টি খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক এই বিচারকার্যের মাধ্যমে ফুটে ওঠে, প্রথমত, একটি দেশ পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত রাজনৈতিক জ্ঞান তাদের নেই, মূলত তারা অত্যন্ত বিবেকবর্জিত এবং একটি সভ্য সমাজে অগ্রহণযোগ্য যেকোন কিছু ঘটিয়ে ফেলতে তারা সক্ষম, দ্বিতীয়ত, তারা সবসময়ই বাঙালিদেরকে সন্দেহ করত এবং যেকোন যেকোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় কম্যুনিস্ট ও ভারতের উস্কানিতে করেছে অপবাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে সবখানে বাধা দেয়া হত।

বর্তমান সংকট

সাম্প্রতিক ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ মুজিব ও তাঁর দল, আওয়ামিলীগ, পূর্ব পাকিস্তানকে বরাদ্দ করা জাতীয় সাংবিধানিক সভার ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টিতেই জয়ী হয়েছে। তাঁর দল ৩১৩টি চেম্বারে স্পষ্টতই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। পাকিস্তানের নব নির্বাচিত জাতীয় সভার ৩ মার্চ তারিখে দেখা করবার কথা ছিল। ৮৩ সদস্যের দল নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো দাবি করেন যে, বাণিজ্য ও সহায়তার নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই থাকা উচিত। যখন শেখ মুজিব অতীত অর্থনৈতিক শোষণের এই হাতিয়ারের সাথে আপোষ করতে অসম্মত হন, ভুট্টো তখন সভায় অংশগ্রহণ করা প্রত্যাখ্যান এবং তার ও অন্যান্য সামরিক নেতাদের পরামর্শে রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান অনির্দিষ্টভাবে সভা স্থগিত করে দেন। 

“ভারতের বিরুদ্ধে হাজার বছরের সংগ্রাম” স্লোগান নিয়ে ভুট্টো নির্বাচনে জয়লাভ করেন। শেখ মুজিব নির্বাচনে জয়ী হন তাঁর বিখ্যাত ছয়দফার জন্য। এটাই হল বাঙালিদের জন্য স্বায়ত্ত্বশাসন, যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে থাকবে সামরিক, পররাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক বিষয়াদির জরুরি কাগজপত্র। একটি রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে, “৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের সমর্থনে করাচির রাস্তায় বেলুচ, পাঠান ও সিন্ধিরা মার্চ করেছিল”। তারা কেবল পশ্চিম পাঞ্জাব প্রদেশ অতক্রম করতে পেরেছিল, যেখানকার লোকেরা পাকিস্তানের সমস্ত উচ্চ পদসমূহ নিয়ন্ত্রণ করে এবং এখানেই ছিল মূল সমস্যা। “ভারতের বিরুদ্ধে হাজার বছরের সংগ্রাম” ছাড়া জনাব ভুট্টো ও পশ্চিম পাঞ্জাবীদের কাছে পাকিস্তান ছিল অর্থহীন এবং সাড়ে সাত কোটি বাঙালির দ্বারা অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধ করার কোন ক্ষমতাই ছিলনা।

কাশ্মির সমস্যা এবং তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যকার একটি চুক্তি আঞ্চলিক কর্পোরেশন ও উন্নয়ন, পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষতিসাধনের মাধ্যমে পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে আরও ত্বরান্বিত করে তুলেছিল। লন্ডনের সানডে টাইমসের ডেভিড হোল্ডেন ঠিকই বলেছেন, “কাশ্মিরের সাথে পাকিস্তানের বারমাসী যুদ্ধে বাঙালিদের কোনকিছু যায় আসে না, তবুও এই যুদ্ধে সামরিক খরচ করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব আয় থেকেই, যার সিংহভাগ অর্জিত হয়েছে বাঙালিদের দ্বারাই”। কাশ্মির ঘটনায় মতামত দিয়ে সম্প্রতি দ্য গার্ডিয়ান বলে, “পাকিস্তান অভিযোগ করে যে, কঠিনভাবে নিপীড়ন করে ভারত পাকিস্তানপ্রেমী কাশ্মিরীদেরকে আটকে রেখেছে। অথচ হাস্যকর ব্যাপার হল এই যে, ইসলামাবাদের জন্তারা নিজেরাই  প্রকাশ্যেই সাড়ে সাত কোটি প্রকৃত পাকিস্তানিদের ওপরে সেই নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। কাশ্মিরের কথা আবারও উঠলে জাতিসংঘ নিশ্চয়ই এবার তিক্ত হাসি হাসবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মত এই বিষয়টিও এখন পুরনো হয়ে গেছে”।

জাতীয় সভার প্রতি ইয়াহিয়া খানের খামখেয়ালী স্থগিতাদেশের কারণে সারা বাংলায় প্রতিবাদ ও মিছিল ছড়িয়ে পড়ে ১ মার্চে, যা সেনাবাহিনী জোরপূর্বক থামানোর সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলার প্রায় ২০০০ স্বাধীনতাকামী ছেলেপেলে এতে প্রাণ হারায়, এই রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ড ঘটা সত্ত্বেও আওয়ামিলীগ স্বাধীনতা ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকে। এর বদলে তারা অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যায়। বিশ্বের ইতিহাসে এই প্রথম বেসরকারি একটি দলের নেতা, শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র সরকারি প্রশাসন কেন্দ্রীয় সরকারের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস করে এবং তাদের অভিযোগসমূহ তাঁর কাছে প্রেরণ করে। এ ছিল এমন এক অসহযোগ আন্দোলন, যে আন্দোলনে এমনকি মহাত্মা গান্ধীও কোনদিন মানুষের মধ্যে এই পরিমাণ ঐক্য, সংহতি ও উৎসর্গের চেতনা অর্জন করতে পারেননি। সেসময়ে এটা প্রমাণিত হয় যে, তিনি কখনই পাকিস্তান থেকে আলাদা হতে চাননি। “পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্তঃপ্রবাহের সুপ্রচারণা সত্ত্বেও তাঁর পরবর্তী দুই সপ্তাহর জন্য আলাপ চালিয়ে যাওয়ার মধ্যেই পাকিস্তানের ঐক্যের প্রতি তাঁর আপোষ ও অঙ্গীকারের প্রস্তুতি ফুটে ওঠে”।

রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানে তার সেনাবাহিনীর ক্ষমতা বাড়াতে চাইছিলেন এবং কোনদিনই তিনি সরল বিশ্বাসে মুজিবের সঙ্গে কোন আপোষ করেন নি। আলাপ চলাকালে তিনি প্রকাশ্যেই বলেন যে, কিছু কিছু বিষয়ে তিনি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন, ২৫ মার্চ তিনি ইসলামাবাদে ফিরে যান এবং পাকিস্তানের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী, শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে সম্বোধন করেন। তিনি তাঁর দলকে অবৈধ ঘোষণা করেন এবং ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ, বৃহষ্পতিবার রাতে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন, যেমনটি আর্মেনিয় খ্রিস্টানদের গণহত্যা ও হিটলারের ইহুদী হত্যার পর অনেকদিন দেখা যায়নি।     

২৫ মার্চ সারা বাংলাদেশ আতংকে চিৎকার করে ওঠে। ভারীবর্ষনের পর সৃষ্ট বন্যার মত রাজপথে রক্ত বয়ে যায়। নারী-পুরুষ-শিশু-কিশোররা আতংকে রাস্তায় ছোটাছুটি করে। আকাশে-বাতাসে তাঁদের চিৎকারের শব্দ ছড়িয়ে পড়ে। অস্ত্র ও গোলাবর্ষণের শব্দে তাদের চিৎকার হারিয়ে যায়। হাজার হাজার লোক মারা যায়। প্রখর রৌদ্রে রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষের লাশে পচন ধরে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জাল ভেদ করে কতিপয় সাহসী সাংবাদিকেরা তাঁদের অদম্য সাহসিকতার পরিচয় দেয় – সারা বিশ্ব এই গণহত্যার বিষয়ে জানতে পারে ও টেলিভিশনের পর্দায় দেখে। বিশ্ব থমকে গিয়েছিল কি? তারা কি আতংক অনুভব করেছিল? তাদের প্রতিক্রিয়া যা-ই হয়ে থাক না কেন, যুদ্ধের শিকার বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ সেকথা কোনদিনও জানতে পারবে না। পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম ও বর্বর গণহত্যার রক্তাক্ত বর্ণনা দিয়েছিল আতংকিত প্রত্যক্ষদর্শীরা। পূর্ব পাকিস্তানের পত্রিকাগুলোর কন্ঠ চেপে ধরা হত, যদি না তাদের অফিসগুলো কামানের গোলার আঘাতে চুর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়ে না থাকত। বিদেশি সাংবাদিকদেরকে লাঞ্ছিত করা হত, শরীরে তল্লাসি করা হত, মানহানির অভিযোগে অবশেষে বিতাড়িত করা হত। একজন ব্রিটিশ ভদ্রমহিলা একজন পাকিস্তানি অফিসারকে জিজ্ঞেস করেছিল, “শিশুগুলোকে কেন মেরে ফেলা হল?” অফিসার উত্তর দিয়েছিল, “অনাথ এই শিশুগুলো পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণা নিয়ে বড় হবে”। বাইরের পৃথিবীর কাছে যেন সত্য প্রকাশ না পায়, সে ব্যাপারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অত্যন্ত সচেষ্ট ছিল।

Scroll to Top