বাংলাদেশে হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা সম্পর্কে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি

শিরোনাম সূত্র তারিখ
১১। বাংলাদেশ হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা সম্পর্কে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি বাংলাদেশ আর্কাইভস, মুজিবনগর ২৩ নভেম্বর ১৯৭১

 

কম্পাইল্ড বাইঃ Razibul Bari Palash

<১১, ১১, ১৯২-১৯৩>

 

 

বাংলাদেশ বাহিনীর হেডকোয়ার্টার, মুজিবনগর

২৩ নভেম্বর ১৯৭১

প্রেস বিজ্ঞপ্তি

বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতা

 

 

গত ৭ মাসে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নৃশংসতার নোংরা কাহিনীর বিবরণ কখনোই সম্পূর্ণ জানা যাবেনা। কিন্তু মুক্তিবাহিনী ক্রমাগত বিভিন্ন এলাকা দখল মুক্ত করার জন্য ধীরে ধীরে এর পরিমাণ কমতে শুরু করেছে। প্রতিটি এলাকার নিজস্ব ভয়াবহ এবং অন্তর্বেদনার গল্প আছে।

 

ভুরুঙ্গামারী-উত্তরাঞ্চলের রংপুরের একটি শান্তিপূর্ণ জনপদ ছিল। গত ছয় মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এমন কোন নির্যাতন নেই যা এখানে সঙ্ঘটিত হয়নি।

 

১৪/১৫ নভেম্বর রাতে ভুরুঙ্গামারীর সাথে উত্তরাঞ্চলের রংপুরের একটি অংশ মুক্তিবাহিনীর দ্বারা শত্রুমুক্ত হয়। তারা শহরে ঢুকে যা দেখেছে তা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে নোংরা ঘটনা হিসেবে ইতিহাসে লেখা থাকবে। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে মধ্যযুগীয় কায়দায় দলবল নিয়ে ভ্রষ্টাচার ও নৃশংসতায় মেতে ছিল পাকিস্তানের পাঞ্জাব রেজিমেন্ট সেনাবাহিনীর ২৫ ব্যাটালিয়নের জওয়ানরা।

 

মুক্তিবাহিনীর একের পর এক শত্রু বাঙ্কারে আক্রমণ করে প্রতিটি ইঞ্চিতে যা দেখেছে তাতে নির্জনে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে। শেষ সময়ে পাকিস্তানি সেনারা একটি স্থানীয় সরকারী ভবনে তাদের চূড়ান্ত আশ্রয় বানিয়েছিল। তারা এটিকে একটি ক্ষুদ্র দুর্গে পরিণত করে। শত্রুসৈন্যরা ক্যাপ্টেন আতাউল্লা খান ও আর্টিলারি অফিসার সেকেন্ড লে মোহাম্মদ নওয়াজ এর নেতৃত্বে এলএমজি, HMG এবং মর্টার থেকে ক্রমাগত আগুনের গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রু অবস্থানের উপর মর্টার ও MMG ব্যবহার করায় একটি অপ্রতিরোধ্য আক্রমণে রূপ নেয়। একটি হিংস্র যুদ্ধের শেষে শত্রু পরাভূত হয় এবং ভুরুঙ্গামারী ছয় মাসের পর মুক্ত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা পালিয়ে যায়। শত্রুদের ক্যাপ্টেনকে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডো নিজের হাতে গুলি করে হত্যা করে। পঁচিশ টি শত্রু মৃতদেহ ভবনের চারপাশে পাওয়া যায়। আর্টিলারি অফিসার লে নওয়াজসহ ১১ জন শত্রুসৈন্যদের বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বাকি শত্রুরা অন্ধকারে পালিয়ে যায়। এত বড় বিজয়ে আনন্দ করার প্রাক্বালে একটি দৃশ্য দেখে তাদের সেই আনন্দ মলিন হয়ে যায়। একটি বদ্ধ কক্ষ থেকে শব্দ শুনে তারা দরজা ভেঙ্গে ফেলে এবং প্রায় ২৫ জন ক্ষুধার্ত এবং নগ্ন আসুস্থ কিছু নারীদের দেখতে পায় যাদের মধ্যে কারো কারো বয়স ছিল ১০ বা ১১। তারা সব নিথর ভাবে তাকিয়ে ছিল এবং মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন লাগছিল। স্কুল ভবনের অন্য একটি কক্ষের তালা ভেঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা পুরুষ ও শিশুদের আরেকটি গ্রুপ পায়। এসব নারীদের মর্মান্তিক কাহিনীর বর্ননা শুনে মুক্তিযোদ্ধারা চোখের জল ফেলতে থাকে।

 

সেখানে একজন স্থানীয় মাদ্রাসার সাবেক শিক্ষকের স্ত্রী ছিলেন কয়েকমাস পর তার শিশুপুত্রের মুখ দেখতে পান। তাঁর ৪০ বছর বয়সী স্বামী ১০ টি কোরান শরিফ দিয়ে স্থানীয় ছেলেমেয়েদের পড়াতেন। পাকসেনারা তাঁর কাছে তাঁর স্ত্রীকে দাবি করলে তিনি অসম্মতি জানান-তাই তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। স্বামীকে হত্যার পর তাকে জোর করে ক্যাপ্টেন আতাউল্লার কক্ষে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তার সন্তানদের একজনকে তার উপস্থিতিতে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করে বাকি ২ সন্তানের ভয় দেখিয়ে তাঁর সম্মতি আদায় করা হয়। তারপর পরবর্তী পাঁচ মাস তিনি একজন নারীর জীবনের সবচেয়ে অপমানকর অগ্নিপরীক্ষা দেন। ভুরুঙ্গামারী স্বাধীনতার পর তিনি তার কনিষ্ঠ সন্তানের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হন। কিন্তু তার অন্য সন্তানকে পাওয়া যায়নি।

 

ভুরুঙ্গামারী মুক্ত হবার আগে পাকবাহিনী জামিলা খাতুন নামে ১১ বছরের এক কিশোরীকে তাঁর মায়ের সাথে একত্রে ধরে নিয়ে অত্যাচার করা হয়। এর চেয়ে জঘন্য আর কোন অপরাধ হতে পারে না।

 

৪০ বছর বয়সই আমিনা খাতুন তখন ছিলেন গর্ভাবস্থার শেষ দিকে-তবু তাকে পাঞ্জাবি সেনারা ক্ষমা করেনি। শিকারের উপর নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পরেছিল। সে প্রতিরোধ করতে গেলে একজন পাকিস্তানি সেনা নৃশংসভাবে বুট দিয়ে তাঁর পেটে লাথি দেয় এবং সে ভয়ঙ্কর ব্যথা পায়-এবং সেই ব্যাথার চোটে সন্তান প্রসব করে ফেলেন। এরপর দিনের পর দিন তাকে অমানবিক ভাবে সৈন্যরা বারংবার ধর্ষণ করে।

 

ইবারুদ্দিন মণ্ডল, অনেকের সাথে স্কুল ঘরের একটি রুমে তালাবদ্ধ অনেক ছিলেন। তার স্ত্রীকে না দিতে চাওয়ায় তার পা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে জখম করা হয়। সৌভাগ্যবসত স্বাধীনতার পর ছাড়া পেয়ে সে জানতে পারে তাঁর স্ত্রী পালিয়ে যেতে পেরেছিল। স্বাধীনতার পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কিছু মুক্তিবাহিনীর সৈন্যদের সাহায্যে তিনি তার স্বামীর দেখা পেয়ে যান।

 

এভাবে প্রায় ৫০০ বন্দীদের প্রত্যেকের ছিল নানা রকম বীভৎস কাহিনী।

 

অফিসের কারারুদ্ধ কক্ষে বন্ধী থাকার সময় প্রকৃতির ডাকে সারা দিতেও তাদের যেতে দেয়া হত না। পুরুষ ও শিশুদের দিয়ে সেনারা বাংকার খনন, জায়গা পরিষ্কার এবং জালানি কাঠ কাটানো-এইসব কাজ করাত। তাদের ঠিক মত খেতে দেয়া হতোনা।

 

ভুরুঙ্গামারী এলাকায় মাইলের পর মাইল মানুষের দুর্দশার পাশা পাশি শুষ্ক ধানক্ষেত এবং বিধ্বংস পাটের গুদাম দেখা যেতে থাকে। এক সময়ের সবুজ এবং শান্তিপূর্ণ এই ভূমি পাকসেনাদের বীভৎস অত্যাচারের নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে।

 

জনসংযোগ কর্মকর্তা

বাংলাদেশ বাহিনী।

Scroll to Top