পূর্ব পাকিস্তানের দাবির সমর্থনে সম্পাদকীয়

<2.125.552>

শিরোনামঃ পূর্ব-পাকিস্তানের দাবীর সমর্থনে সম্পাদকীয়

সূত্রঃ সাপ্তাহিক ‘ফোরাম’

তারিখঃ ১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭০ 

.

পাকিস্তানের একীভূতকরণ

 

পশ্চিম পাকিস্তানি পাঠক ফোরামের সদস্যদের এটি মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ক্ষমতা এবং ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ব্যাপারটাকে নিয়ে আমরা বৃথাই অধিক মাথা ঘামাচ্ছি। এখানে বসবাস করে এমনটা না ভাবাটাই বরং অস্বাভাবিক। নিজেদের পৈতৃক সম্পদ ফিরে পাওয়ার জন্য বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে অসংখ্য রাজনৈতিক সংগ্রাম চালানো একটা সমগ্র জাতির জন্য দুই দশক অনেক সময়। যদিও আমরা চাই না, আমাদের করা এই প্রতিজ্ঞা থেকে যেন এটা ধরে নেয়া না হয় যে পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইদের গভীর দুঃখ এবং বেদনাকে আমরা হিসাবের মধ্যে ধরছি না। যে দুঃশাসন পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে তা এখন সর্বহারা হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের উপর চেপে বসেছে।

 

পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার ফিরে পাবার আন্দোলন গত দুই দশক ধরে ক্ষমতাসীন অভিজাতদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হতে দেখা গেছে। এই অভিজাত সম্প্রদায়, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে পশ্চিম পাকিস্তানে বাস করে এবং দেশের আপামর জনগণের কথা চিন্তা না করে নিজেদের ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যেই স্বার্থকে সীমাবদ্ধ রাখে।

 

এই দীর্ঘকাল ব্যাপী আন্দোলন থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের পথে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ অন্তরায় নয়, বরঞ্চ, বড় বড় ব্যবসায়ী এবং জমিদারেরা দায়ী। কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রে দালালরা, যাদের পশ্চিম পাকিস্তানেও বাড়ি আছে, এটা নিশ্চিত করেছে যেন পূর্ব পাকিস্তানের উন্নতি করতে গিয়ে যেন তাদের ঘাড়ে ট্যাক্সের বোঝা চেপে না বসে। তারা যখন ট্যাক্স মুক্ত সুবিধা ভোগ করছে, তখন সুবিধাভোগী অভিজাত সম্প্রদায় সস্তা বিদেশী সাহায্য, চিপ মানি, বাজার সীমিতকরণ এবং শ্রমজীবি মানুষের বেতন কমানোর হুকুম দিচ্ছে। বৈষম্য বাড়ার পাশাপাশি  ২২টি পরিবারের চরম উন্নতি সাধন কোন কাকতালীয় ঘটনা নয়।

 

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের এই সমধর্মী স্বার্থ অবশ্য এটি নির্দেশ করে না যে, তাদের সংগ্রামের ধরণ একই হবে। অভিজাত সম্প্রদায় যখন দুই প্রদেশের উপর বিশাল মূর্তি হয়ে ছড়ি ঘোরাচ্ছে, দুই প্রদেশে এর ক্ষমতা সমান তীব্র নয়।

 

পূর্ব পাকিস্তানে তারা ঘুষের এক রাজত্ব গড়ে তুলেছে, যা পশ্চিম অংশের পূর্ব অংশের উপর প্রাধান্য বিস্তার রাখার উপর নির্ভরশীল। দেশীয় যেসব দালাল তাদের ফ্রন্ট ম্যান হিসেবে এখানে কাজ করে, তারা ক্ষমতার দিক থেকে এত দুর্বল যে কেন্দ্রের প্রতিরোধক ছাতা তাদের পিঠ থেকে সরে গেলে তারা নিজেরা দাঁড়াতে পারবে না। তাদের আর্থিক সাহায্য বন্ধ হয়ে গেলেই পূর্ব পাকিস্তানের পুঁজিবাদীরা এবং সদ্য জন্ম নেয়া সাধারণ মানুষের সমাজ সচেতনতা সমান সমান টক্কর দিবে। সিধেল চোর আর ছ্যাচোড় জেল দাগীদের থেকে ডাকাত বা ব্যারন তৈরী হয় না।  গালে তুলে খাইয়ে খাইয়ে ব্যারন বানাতে হলেও দুই দশকে তা সম্ভব নয়। এতদিন কে অপেক্ষা করবে? তারচেয়ে বরং সেই একই ঝাড়ু যা পূর্ব পাকিস্তানকে ম্যাক লিওড রোড থেকে বন্ধন মুক্তির স্বাদ দিয়েছিল, সেই একই ঝাড়ু দিয়ে তাদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হোক এবং আমাদের শিল্প ও বাণিজ্যকে জনগণের সম্পদে পরিণত করা হোক।

দুর্ভাগ্যবশত, পশ্চিম পাকিস্তানে এই শোষণ আরও গভীরে প্রোথিত হয়েছে। জমিদারেরা শতাব্দীকাল ধরে প্রথমে বৃটিশ শাসকদের প্রতিনিধিরূপে এবং পরে স্ব-অধিকারের ভিত্তিতে এসব এলাকায় কর্তৃত্ব এবং রাজত্ব পরিচালনা করে আসছে। এই ক্ষমতা ধ্বংস করার মত সামর্থ্য কেবল সংসদ কিংবা সংবিধানের নেই। জমির উপর এই জমিদার শ্রেনীর কর্তৃত্ব হ্রাস করার পূর্বে পশ্চিম পাকিস্তানকে দ্বন্দ্বের সাগর পাড়ি দিতে হবে। জমিদার আর আমলাদের মধ্যকার সংযোগসূত্র বিচ্ছিন্ন হলে অর্থাৎ গ্রামগুলি তথা পশ্চিম পাকিস্তানে সত্যিকারের গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটলেই কেবল চাষীরা কৃষিজমি পেতে সমর্থ হবে।

 

বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানও একইভাবে কুক্ষিগত হয়ে আছে । যদিও তারা ক্ষমতাসীন জোটের কণিষ্ঠ অংশীদার হিসেবে শুরু করেছিলেন, তবুও তাদের কাজের ধরণ জ্যেষ্ঠদের মতই। এখন তাদের জমি আছে, জমিদারী আছে আবার শিল্পপ্রতিষ্ঠান অর্থাৎ ককটেল লাউঞ্জেও অংশীদারিত্ব আছে। আমলারা তাদের ইচ্ছায় ওঠে আর বসে যেহেতু রক্ত আর অর্থের উপরই তাদের জোটটি বকাশ লাভ করেছে। এই ঘনিষ্ঠভাবে গড়ে ওঠা জোট না ভাঙ্গা পর্যন্ত কোন আইনগত বিলই পশ্চিম পাকিস্তানের এমনকি একটি দোকানও জাতীয়করন করতে পারবে না, ব্যাংক আর শিল্পপ্রতিষ্ঠান তো দূরের কথা।নির্বাচন নয় বরং তার পুর্বেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অনেকগুলো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে ।

 

এটা বলছি না যে বিগত আন্দোলনে তাদের আত্মবিশ্বাস টলে যায়নি। শেষ হিসেবের সময়ের কথা মাথায় রেখে এই ২২ পরিবার আরও দূরদর্শিতার সাথে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তাদের কার্যক্রমের পরিসর বিস্তৃত করছে। তবে, তারা এখনো বিশ্বাস করে যে সে সময় এখনো আসেনি এবং সময় আসলে তাকে পর্যদুস্ত করতে তারা মুক্তহস্তে খরচ করবে। চূড়ান্ত সময় আসলে তারা বন্দুক নিয়ে মাঠে নামবে কারণ তাদের ধারণা ব্যারিকেড গুলোতে জমিদার আর আমলারা তাদের পাশেই থাকবে।

 

পশ্চিমের তুলনায় পুর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন এবং তাদের সামাজিক বিপ্লব তুলনা মূলক সমাসন্ন। যদিও তার জন্য সংগ্রামের পথে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের অংগীকার সংকুচিত হবে না। পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম বারের মত অভিজাতদের হাতে কুক্ষিগত ক্ষমতা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে বলেই মনে হচ্ছে। এই অভিজাতদের প্রথম পরাজয় তাদের যতটাই হতোদ্যম করে ফেলবে ততটাই উৎসাহিত হবে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ। পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হওয়ার সাথে সাথে সেখানে তাদের শোষণের চারণভূমিও সংকীর্ণ হয়ে পড়বে, ফলে তারা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পশ্চিম পাকিস্তানে শোষণের মাত্রা আরও বৃদ্ধি করবে। এটা এমন একটা সময় পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের সমাজের মধ্যে দ্বন্দ্বকে আরও উসকে দেবে, যখন জনগণের সচেতনতা থাকবে তুঙ্গে। সম্মুখ সমরটা হয়ত সহিংস হবে তবে এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে দুই অংশের যে কোন একটাতে তাদের থাবা শিথিল হওয়ার সাথে সাথেই তা শুরু হবে। আজকে যখন জনগণ  পাকিস্তানের ঐক্য ও অখণ্ডতা নিয়ে কথা বলে তখন তারা ঐ শোষক শ্রেণীর ঐক্য আর অখণ্ডতা নিয়েই শঙ্কিত থাকে। দুই অংশের জনগনের মধ্যে এই ঐক্য সর্বদাই বিরাজ করবে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ন্যায়বিচার আর জাতির এই সামাজিক বিপ্লবের সংগ্রামের স্বার্থে তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ হোক।

Scroll to Top