ঢাকার গণহত্যার ওপর সায়মন ড্রিং এর প্রতিবেদন

 <2.221.788>

বাংলাদেশে গণহত্যা

কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ

“ঢাকাকে কীভাবে একটি অবিভক্ত পাকিস্তানের মূল্য দিতে হল”

ডেইলি টেলিগ্রাফ, লন্ডনের সাইমন ড্রিং-এর প্রতিবেদন

 

পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সেনাবাহিনী কর্তৃক ধরে নিয়ে যেতে দেখা যায়, এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগের অধিকাংশ শীর্ষ নেতাকেও গ্রেফতার করা হয়।

শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের অধিকাংশকে গ্রেফতার করা হয়, বাকিদের মেরে ফেলা হয় এবং মুজিবের আন্দোলনের সমর্থক দুটি পত্রিকার কার্যালয়ও ধ্বংস করে দেয়া হয়।

কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, ২৫শে মার্চ, বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকায় আগত ট্যাংকগুলোর প্রধান লক্ষ্য ছিল ছাত্ররা।

সেনাবাহিনীর আনুমানিক ৩টি ব্যাটালিয়ন ঢাকা আক্রমণে ব্যবহৃত হয় – একটি সাঁজোয়া, একটি গোলন্দাজ, এবং একটি পদাতিক। রাত ১০টার একটু আগে তারা ব্যারাক ছাড়তে শুরু করে। ১১টা নাগাদ গোলাগুলি শুরু হয় এবং যারা উল্টানো গাড়ি, গাছের গুঁড়ি, আসবাবপত্র, কংক্রিটের পাইপ দিয়ে অস্থায়ী ব্যারিকেড তৈরি করতে শুরু করেছিলেন তাঁরা প্রথম হতাহতের শিকার হন।

শেখ মুজিবুরকে টেলিফোনে সতর্ক করে দেয়া হয় যে কিছু একটা ঘটছে, কিন্তু তিনি বাড়ি ছাড়তে রাজি হননি। গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হওয়া এক সাহায্যকারীকে তিনি বলেন, “আমি আত্মগোপনে গেলে তারা আমাকে খুঁজে বের করতে সমগ্র ঢাকা জ্বালিয়ে দেবে।”

ছাত্রদেরকেও সতর্ক করা হয়, কিন্তু যারা ছিল তারা পরে জানায় যে তাদের অধিকাংশই ভেবেছিল যে তাদের কেবল গ্রেফতার করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত এম-২৪ ট্যাংক চালিত একটি সেনাদল মাঝরাতের পরপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অগ্রসর হয়। দলটি ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি দখল করে নেয় এবং এটিকে নিকটবর্তী ছাত্রাবাস এলাকায় গোলাবর্ষণের জন্য ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে।

আকস্মিক এই আক্রমণে সামরিক সরকারবিরোধী ছাত্র ইউনিয়নের সদর দপ্তর ইকবাল হলে প্রায় ২০০ ছাত্র নিহত হয়। দুই দিন পর, পোড়া ঘরগুলোতে তখনো লাশগুলো পুড়ছিল, বাকি লাশগুলো বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল, কিছু ভাসছিল নিকটস্থ একটি লেকে, চারুকলার এক ছাত্রের লাশ পড়ে ছিল তার ইজেলের উপরে।

মিলিটারি অনেকগুলো লাশ সরিয়ে ফেলেছিল, ইকবাল হলের বারান্দার সমস্ত রক্ত কখনোই কেবল অবশিষ্ট ৩০টি লাশের কারণে হতো না।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, অপর এক ছাত্রাবাসে সৈন্যরা তাড়াহুড়ো করে খোঁড়া এক গণকবরে নিহতদের কবর দেয় এবং তা পরে ট্যাংক দিয়ে বুজে দেয়া হয়।  

 

 

<2.221.789>

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে বসবাসরত মানুষদের অনেকেই হামলার শিকার হন এবং একটি রেললাইনের ধারে প্রায় ২০০ গজ ধরে চলা কুঁড়েঘর ধ্বংস করে দেয়া হয়।

টহলরত সৈন্যরা নিকটবর্তী বাজার এলাকাও ছারখার করে দেয়। দুইদিন পর যখন বাইরে এসে এসব প্রত্যক্ষ করা সম্ভব হয়, বাজারের বেশ কয়েকজন দোকানদার তখনো কাঁধ পর্যন্ত কম্বল জড়িয়ে শুয়ে ছিলেন, যেন ঘুমন্ত। একই জেলায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে সরাসরি মিসাইল আঘাত হানে এবং একটি মসজিদ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন হামলা করা হয় তখন শহরের অন্য প্রান্তে ইস্ট পাকিস্তান পুলিশের রাজারবাগ সদর দপ্তরে সেনাবাহিনীর অন্য কয়েকটি দল অগ্রসর হয়। প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ট্যাংক দিয়ে আক্রমণ শুরু করা হয়, এবং পরবর্তীতে সৈন্যরা ভিতরে ঢুকে আগ্নেয়াস্ত্র নিক্ষেপ করে পুরুষদের কোয়ার্টার ধ্বংস করে দেয়। বিপরীত পাশের বাসিন্দারা বলতে পারেননি কতজন সেখানে মারা যায়, তবে অবস্থানরত ১১০০ পুলিশ সদস্যের খুব বেশি সংখ্যক পালাতে সক্ষম হয়নি বলে ধারণা করা হয়।

 

মুজিব গ্রেপ্তার

এই ঘটনা চলাকালে অন্যান্য ইউনিট শেখের বাড়ি ঘেরাও করে। রাত ১টার কিছু আগে তাঁর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান যে তিনি যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণের আশঙ্কা করছেন এবং তাঁর গৃহকর্মী ও দেহরক্ষী বাদে সকলকে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

একজন প্রতিবেশী জানান যে রাত ১.১০ এ একটি ট্যাংক, একটি সাঁজোয়া গাড়ি এবং সৈন্যভর্তি কিছু ট্রাক বাড়ির উপর গুলি চালাতে চালাতে এগিয়ে আসে। তারা বাইরে থামলে একজন অফিসার ইংরেজিতে ডাক দেয়, “শেখ, নিচে নেমে আসো।” মুজিবুর বারান্দায় বের হয়ে আসেন এবং বলেন, “হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত, কিন্তু গুলি চালানোর কোন প্রয়োজন নেই। তোমরা টেলিফোনে আমাকে ডাক দিলেই আমি চলে আসতাম।”

এরপর একজন অফিসার উঠানে এগিয়ে যায় এবং মুজিবকে বলে, “তোমাকে গ্রেফতার করা হল।”

তিনজন গৃহকর্মী, একজন সাহায্যকারী এবং দেহরক্ষীসহ (যে অফিসারকে অপমান করেছিল বলে মারাত্মক মারধরের শিকার হয়) তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। পাশের বাড়ির বেড়ার পিছনে লুকিয়ে থাকা এক পাহারাদারকে হত্যা করা হয়।

শেখকে যখন সেনা সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন সৈন্যরা বাড়িতে ঢুকে সকল নথিপত্র নিয়ে যায়, ভাংচুর চালায়, বাগানের গেটে তালা লাগিয়ে দেয়, লাল-সবুজ-হলুদ “বাংলাদেশের” পতাকাটিতে গুলি চালায় এবং এরপর ফিরে যায়।

 

শুক্রবার রাত ২টা

সারা শহরে আগুন জ্বলছিল, এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও তার আশেপাশের এলাকাগুলো সেনারা দখল করে নিয়েছিল। কিছু এলাকায় তখনো ভারী বোমাবর্ষণ হচ্ছিল, তবে যুদ্ধ ক্রমশ শিথিল হয়ে আসছিল। সৈন্যরা এলাকার অধিকাংশ ঘরবাড়ির মত ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের বিপরীত পাশে “দি পিপল” পত্রিকার অফিস পুড়িয়ে দেয়, এবং নিরাপত্তারক্ষীকে মেরে ফেলে।

 

শহরজুড়ে নীরবতা

ভোরের কিছু আগে গোলাগুলি প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়, এবং কাকের ডাক, হঠাৎ হঠাৎ সৈন্যদলের পায়ের শব্দ ও দুই-তিনটি ট্যাংকের শব্দ বাদে নীরব এবং সম্পূর্ণ মৃত শহরটিতে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এক ভূতুড়ে নীরবতা বিরাজ করে।

 

 

 

<2.221.790>

দুপুরে কোন পূর্বাভাস ছাড়াই শহরের পুরাতন অংশে (যেখানে সংকীর্ণ গোলকধাঁধার মত রাস্তায় প্রায় ১০ লাখ লোকের বাস) সেনাবাহিনীর কয়েকটি দল আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে।

পরবর্তী ১১ ঘণ্টা সৈন্যরা “পুরান ঢাকা”র বড় বড় কিছু এলাকা ধ্বংস করে দেয়। এসব এলাকা থেকে মুজিব তাঁর সমর্থনের বড় একটি অংশ লাভ করেছিলেন। ঢাকা ইংলিশ রোড, ফ্রেঞ্চ রোড, নয়া বাজার, সিটি বাজার এলাকা পুড়িয়ে ছারখার করে ফেলা হয়। 

“তারা হঠাৎ রাস্তার শেষ মাথায় এসে হাজির হয়,” নয়াবাজার এলাকায় বসবাসকারী এক বৃদ্ধ জানান, “এরপর তারা সব বাসাবাড়িতে গুলি চালাতে চালাতে ধ্বংস করে ফেলে।”

প্রথম দলটির সঙ্গে সঙ্গে আসে গ্যাসোলিনের ক্যান বহনকারী একদল সৈন্য। যারা পালানোর চেষ্টা করে তাদের গুলি করে মারা হয়। যারা থেকে যায় তাদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়। আমাকে বলা হয়, প্রায় ৭০০ নারী, পুরুষ ও শিশু সেদিন দুপুর ১২টা থেকে ২টার মধ্যে মারা যায়।

প্রায় আধা বর্গমাইল জুড়ে অন্তত তিনটি এলাকায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা হয়। পুরান ঢাকার থানাগুলোতেও হামলা চালানো হয়।

 

কনস্টেবল নিহত

“আমি আমার কনস্টেবলদের খুঁজছি”, একটি বাজারের ধ্বংসাবশেষ ঘুরতে ঘুরতে জানান এক পুলিশ পরিদর্শক, “আমার জেলায় ২৪০ জন থাকার কথা, যার মধ্যে আমি মাত্র ৩০ জনকে খুঁজে পেয়েছি – প্রত্যেকে মৃত।”

জনশ্রুতি আছে যে, পুরান ঢাকার হিন্দু পল্লীতে পাক সেনারা মানুষকে বাড়ি থেকে বের হতে বাধ্য করে এবং দলবদ্ধ অবস্থায় তাদের উপর গুলি চালায়। এই এলাকাও পরে ধূলিসাৎ করে দেয়া হয়।

২৬শে মার্চ, রাত প্রায় ১১টা পর্যন্ত সৈন্যরা স্থানীয় বাঙালি চরদের সাথে নিয়ে পুরান ঢাকায় তাদের কর্মকাণ্ড চালায়। সেনারা মশাল জালিয়ে দিতো এবং চর আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়ি দেখিয়ে দিতো। এরপর বাড়িগুলোকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া হতো – ট্যাংকের গোলা বা রিকয়েলবিহীন রাইফেলের গুলিতে অথবা গ্যাসোলিনের ক্যান দিয়ে।

ইতোমধ্যে মফস্বলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা  শেখের সমর্থক এলাকাগুলো থেকে ১০ মাইল দূরে বাণিজ্যিক এলাকাগুলোর দিকে যেতে থাকে।

রবিবার সকাল পর্যন্ত এসব এলাকায় গুলিবর্ষণ চলে, কিন্তু অপারেশনের মূল অংশ শেষ হয়ে যায় শুক্রবার রাতের মধ্যে – শুরু হওয়ার ঠিক ২৪ ঘণ্টা পর।

শেষের দিকের লক্ষ্যগুলোর মধ্যে একটি ছিল বাংলা দৈনিক “ইত্তেফাক”। ধ্বংসযজ্ঞ শুরুর পর প্রায় ৪০০ মানুষ এর কার্যালয়ে আশ্রয় নেয় বলে শোনা যায়। শুক্রবার বিকেল ৪টায় এর বাইরের রাস্তায় ৪টি ট্যাংক এসে অবস্থান নেয়। ৪.৩০টার মধ্যে দালানটি অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। শনিবার সকালে পেছনের ঘরগুলোতে গাদাগাদি করে থাকা পোড়া দেহাবশেষ ছাড়া সেখানে আর কিছুই ছিল না।

 

সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার

যে দ্রুতগতিতে তারা এসেছিল, ততটাই দ্রুতগতিতে সেনারা রাস্তা থেকে চলে যায়। শনিবার সকালে রেডিওতে ঘোষণা করা হয় যে সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হবে।

 

 

<2.221.791>

তারপর আবারও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ, সংবাদমাধ্যমের উপর সীমাবদ্ধতা আরোপ ও সকল সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজে ফিরতে আদেশ জারি করে সামরিক প্রবিধান প্রচার করা হয়। সকল ব্যক্তিগত মালিকানার অস্ত্র কর্তৃপক্ষের নিকট সমর্পণের আদেশ প্রদান করা হয়।

জাদুমন্ত্রের মত নগরে প্রাণ ফিরে আসে, সেই সাথে নেমে আসে আতঙ্ক। সকাল ১০টার মধ্যে পুরান ঢাকার বিভিন্ন অংশ এবং শিল্প এলাকার উপর ভাসমান কালো ধোঁয়ার মতই রাস্তাগুলি ভরে যায় ঘরছাড়া মানুষের স্রোতে। ঢাকাবাসীরা তাদের স্বর্বস্ব নিয়ে গাড়িতে, রিকশায় এমনকি পায়ে হেঁটে তাদের শহর ছেড়ে যাচ্ছিল। দুপুর হতে হতে এই উদ্বাস্তুদের সংখ্যা দশ হাজার ছাড়িয়ে গেল।

“আমি বুড়ো মানুষ, আমাকে একটু তুলে নাও”

“আল্লাহর ওয়াস্তে কেউ আমাকে সাহায্য কর”

“আমার বাচ্চাদেরকে অন্তত আপনার সাথে নিয়ে যান”

নীরব ও গম্ভীরমুখে তারা সেনাবাহিনীর তাণ্ডবের চিহ্নের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তারা মুখ ফিরিয়ে নিল এবং হাঁটতেই থাকল। হঠাত বাজারের দিক থেকে বন্দুকের আওয়াজ এলো। সেকেন্ডের মধ্যে ২০০০ লোক দৌড়াতে শুরু করল; যদিও পরে দেখা গেল আওয়াজটা এসেছিল অস্ত্রসমর্পণের লাইন থেকে।

সরকারী দপ্তরগুলি প্রায় সম্পুর্ণই খালি ছিল। অধিকাংশ কর্মচারীই কাজে ফেরার আদেশ অগ্রাহ্য করে গ্রামে চলে যাচ্ছিল। যারা পালাচ্ছিল না তারা ধোঁয়াচ্ছন্ন ধ্বংসস্তুপের মধ্যে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, জায়গায় জায়গায় আগুনেপোড়া ঢেউটিন (যা অধিকাংশ বস্তিতে ছাদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়) তুলে ছাই থেকে যা কিছু পারে কুড়িয়ে নিচ্ছিল।

শহরের অর্ধেক গাড়িই হয় মফস্বলগামী যাত্রী বহন করছিল অথবা রেড ক্রসের পতাকা উড়িয়ে আহত ও নিহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল।

এসবের মাঝে হঠাত হঠাত সৈন্যবাহী গাড়িও দেখা যাচ্ছিল, তাদের যাত্রীরা নীরব জনতার মতই গম্ভীরভাবে বন্দুকের নল ঘুরাচ্ছিল। শুক্রবার রাতে সেনানিবাসে ফেরার সময় তারা “নারায়ে তাকবীর” (একটি প্রাচীন ফারসি রণহুঙ্কার যার অর্থ “আমরা যুদ্ধজয় করেছি”) বলে চিৎকার করেছিল। শনিবারে যখনই তারা মুখ খুলল তখনই চিৎকার করে বলল “পাকিস্তান জিন্দাবাদ-পাকিস্তান চিরজীবী হোক”।

 

পতাকার ব্যবসা রমরমা

অধিকাংশ মানুষই পরিস্থিতি বুঝে ফেলেছে। সান্ধ্য আইন জারি হওয়ার আগে বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া দুইটি পণ্য ছিল গ্যাসোলিন ও পাকিস্তানের পতাকা। বাসা ছাড়ার আগে যেকোনো পরিবার পাকিস্তানের পতাকা টাঙিয়ে যাচ্ছে, যেন এটা তাদের অবর্তমানে তাদের সম্পত্তি রক্ষা করবে।

শনিবার বিকাল চারটায় রাস্তাঘাট আবারও খালি হয়ে যায়। সৈন্যরা পুনরাবির্ভূত হয় এবং ঢাকায় আবারও নীরবতা নেমে আসে। কিন্তু এ নীরবতা খুব শীঘ্রই ভেঙে পড়ে গোলাগুলির আওয়াজে। দিনের শুরুতেই রেডিওতে ঘোষণা দেয়া হয়েছিলঃ চারটার পর বাইরে থাকা যেকোন ব্যক্তিকে গুলি করা হবে।

কার্ফু শুরুর দুই মিনিট পর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনের রাস্তায় দৌড়ানো অবস্থায় একটি ছোট ছেলেকে থামিয়ে এক সেনা কর্মকর্তা চারবার চড় দেয় এবং জীপে তুলে নিয়ে যায়।

ঔপনিবেশিক আমলের একটি বার, ঢাকা ক্লাবের দারোয়ানকে ক্লাবের গেট বন্ধ করার সময় গুলি করা হয়। রেসকোর্সের মাঝে একটি মন্দিরের আশেপাশে বসবাসরত এক দল হিন্দু পাকিস্তানিকেও খোলা জায়গায় থাকার দায়ে মেরে ফেলা হয়।

 

<2.221.792>

শহরত্যাগের পথে সেনাপাহারা থাকায় ফিরে আসা শরণার্থীদের মুখ থেকে জানা যায় কতজন রাস্তা থেকে নেমে সৈন্যদের পাশ কাটাতে গিয়ে মারা পড়ে।

এসব প্রতিবন্ধকের ওপারে অনেকটা নো-ম্যান’স ল্যান্ড, যেখানে এখনো “ক্লীনিং অপারেশন” চলছে। সেখানে এখন কী হচ্ছে তা সেনাবাহিনী বাদে আর সবাই কেবল কল্পনাই করতে পারে।

অনেকেই রাস্তার ভীড়ের বদলে নদীপথে শহরত্যাগ করেছে; তবে এদের মধ্যে অনেকে কার্ফুর সময় নৌকার অপেক্ষায় নদীতীরে আটকা পড়েছে। শনিবার বিকালে এমন একটি দল ঘাটে বসে ছিল; পরদিন সেখানে শুধু রক্তের দাগ পাওয়া যায়।

বলতে গেলে কোথাওই সংগঠিত প্রতিরোধের কোন চিহ্ন ছিল না। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসাররাও প্রতিরোধের চিন্তাকে উপহাস করে উড়িয়ে দিচ্ছে।

“এসব জঘন্য লোক”, এক পাঞ্জাবি অফিসার বলেন, “এরা তো চাইলেও আমাদের মারতে পারত না”।

“এখনই সব ভাল আছে”, আরেক অফিসার বলেন, “কেউ কিছু বলতে পারে না, কেউ ঘর থেকে বেরুতেও পারে না। বের হলেই আমারা তাদের মেরে ফেলব-তারা যথেষ্ট কথা বলেছে-তারা রাষ্ট্রদ্রোহী, আমাদের মত না। আমরা আল্লাহ ও একতাবদ্ধ পাকিস্তানের জন্য লড়ছি”।

 

 

(ওয়াশিংটন পোস্টের ৩০ মার্চ, ১৯৭১ সংখ্যায় প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফের সাইমন ড্রিং কর্তৃক প্রেরিত বার্তা)

Scroll to Top