জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের কর্মসূচী

<৪,২৪৯,৫৬৪-৫৬৬>

   অনুবাদক- কাজী সাদিকা নূর

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৪৯। জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের কর্মসূচী জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট ……১৯৭১

 

জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের কর্মসূচী

যে নিম্নতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে বর্তমানে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের প্রচেষ্টা চালানো যাইতে পারে, তাহা হইলঃ

(১) পাকিস্তানেরপ্রতিক্রিয়াশীলশাসকগোষ্ঠীর দখলকারী সৈন্যবাহিনী সশস্ত্র সংগ্রামের দ্বারা পরাভূত ও বিতাড়িত করা, বাংলাদেশকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করা এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জনের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসাবে গড়িয়া তোলা।

(২) এই রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বময় ও সার্বভৌম ক্ষমতা জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বমূলক আইন সভার হাতে ন্যস্ত করা, প্রাপ্তবয়স্কদের সার্বজনীন ভোটাধিকার ও যুক্তি নির্বাচন প্রথার ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন চালু করা, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ফিরাইয়া আনিবার অধিকার জনগণকে দেওয়া, পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র নিশ্চিত করা এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।

(৩) জনগণকে বাক স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, রাজনৈতিক দল ও সংঘ গঠনের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রভৃতি মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করা, শ্রমিক কৃষক ও অন্যান্য জনতা যাহাতে ঐসব অধিকার অবাধে ভোগ করিতে পারে তাহার ব্যবস্থা করা, সর্ববিধ দমনমূলক আইন রহিত করা, রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিসমূহ নির্ধারণের ব্যাপারে জনসাধারণ যাহাতে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করিতে পারে তাহার পূর্ণ সুযোগ দেওয়া, নগর, শহর ও গ্রামে স্থানীয় ব্যাপার সমূহ পরিচালনার জন্য জনগণের নির্বাচিত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান সমূহ স্থাপন করা এবং সহকারী শাসন পরিচালনার কার্যে এই সব প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা গ্রহণ করা। বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ হইতে পৃথক করা এবং কোন আইন বিধিসম্মত কিনা তাহা নির্ধারণের ভার বিচারালয়ের উপর অর্পণ করা।

(৪) রাষ্ট্রের চোখে জাতি-ধর্ম, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার স্বীকার করা এবং ধর্মগত ও মতাদর্শগত কারণে কারোর প্রতি কোন বৈষম্যমূলক আচরণ না করা।

(৫) প্রত্যেক নাগরিক নিজ বিবেক-বুদ্ধি অনুযায়ী মতামত ও ধর্মীয় বিশ্বাস পোষণ ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের অধিকার নিশ্চিত করা। কাহারও ধর্ম বিশ্বাসে হস্তক্ষেপ না করা। সকল প্রকার সাম্প্রদায়িক প্রচারণা বেআইনি করা। সকল প্রকার সাম্প্রদায়িক দল ও শত্রুদের দালালী করিয়াছে এমন সব দলকে বেআইনি করা।

(৬) পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ও বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা শিক্ষিত, তাহাদের প্রতি অনুরুক্ত ও সম্পর্কিত সকল স্তরের সমস্ত প্রকার কর্মচারীদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিকযন্ত্র হইতে অপসারণ করা। আমলা, পুলিশ প্রভৃতির ক্ষমতা সীমিত করা।

(৭) বাংলাদেশের দেশরক্ষা বাহিনীকে একটি প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও গণস্বার্থকারী সৈন্যবাহিনী হিসেবে গড়িয়া তোলা।

(৮) বাংলাদেশের উপজাতি জনগণের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক তথা সামগ্রিক বিকাশের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা।

(৯) রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে ভারী ও মূল শিল্প গড়িয়া তোলা, শিল্পের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে প্রধান নির্ধারিত শক্তি হিসাবে গড়িয়া তোলা, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ইত্যাদির উপর গনপ্রতিনিধিমূলক আইনসভার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহ পরিচালনার ক্ষেত্রে সেইসব শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে শিল্প গঠনের মূলধন সংগ্রহ ও অর্থনীতির উপর হইতে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের কর্তৃত্ব বিলোপের জন্য ব্যাংক, বীমা, পাট শিল্প ও ব্যবসা, দদেশিক বাণিজ্য এবং প্রধান পরিবহণ ব্যবস্থা জাতীয়করণ করা। যাহার মুক্তি সংগ্রামে সহযোগিতা করিয়াছেন, তাহাদের শিল্প, বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা জাতীয়করণ করা হলে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া।

রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে শিল্প বিস্তারের জন্য পুঁজিপতিদের বিশেষত স্বল্প পুঁজির মালিকদের উৎসাহ প্রদান ও তাহাদের সুযোগ সুবিধা দান। সমাজব্যবস্থা নির্বিশেষে সকল দেশের সাথে সমতার ভিত্তিতে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করা এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণ করা। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি বিশেষতঃ  ভারতের সহিত ব্যবসা বাণিজ্যের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করা।

(১০) (ক) ভুমি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আশু প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন। জমির সিলিং পরিবার প্রতি ১০০ বিঘায় নির্ধারিত করা এবং উদ্বৃত্ত জমি গরিব ও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে অগ্রধিকারের ভিত্তিতে বিতরণ করা। যেসব ভু-স্বামীর ভূমি সরকারি আয়ত্তে নেওয়া হইবে, তাহাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া। সরকারের খাস জমি ভূমিহীন ও গরিব কৃষকদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণ করা।

(খ) ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকদের খাজনা হইতে রেহাই দেওয়া। ক্রমে খাজনা প্রথা তুলিয়া দিয়া জমির উৎপন্ন ফসলের মোট আয়ের উপর আনুপাতিক হারে আয়কর ধার্যের নীতি অনুসরণ করা।

(গ) পাট ও অন্যান্য অর্থকারী ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা।

(ঘ) ক্ষেতমজুরদের জন্য যোগ্য মজুরী নিশ্চিত করা।

(ঙ) কৃষকদিগকে সমবায় চাষে উৎসাহিত করা, রাষ্ট্র হইতে কৃষির আধুনিক যন্ত্রপাতি, সার নামমাত্র সুদে কৃষিঋণ প্রভৃতি দ্বারা কৃষকদিগদের সাহায্য করা।

(১১) বন্যা, জলোচ্ছ্বাস নিরোধ এবং সেচ ব্যবস্থার কাজকে রাষ্ট্র হইতে জরুরী কর্তব্য হিসেবে গ্রহণ করা এবং ঐগুলির জন্য রাষ্ট্র হইতে যথাযোগ্য ব্যবস্থা অবলম্বন করা।

(১২) অবৈতনিক সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা, কম খরচে সকল প্রকার উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করা, বহুসংখ্যক বিদ্যালয়, বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার, ডাক্তারি, কৃষি ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা এবং শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করতঃ আধুনিক বৈজ্ঞানিক পন্থায় ও ধর্মনিরেপেক্ষভাবে শিক্ষাদানের প্রস্তাব গ্রহণ।

বাংলাদেশের শিক্ষার সকল স্তরে বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা এবং বাংলা ভাষার বিকাশের জন্য রাষ্ট্র হইতে সকল প্রকার সাহায্য দান। বাংলাদেশে বসবাসকারী উর্দু ভাষাভাষীদের নিজেদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ ও নিজেদের সাংস্কৃতিক জীবন গড়িয়া তোলার অধিকার দান।

(১৩) জনগণের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নের কাজকে যথোচিত গুরুত্ব দিয়া উহার জন্য রাষ্ট্র হইতে বেশি করিয়া অর্থ ব্যয় করা এবং চিকিৎসার সুযোগ জনগণের জন্য সহজলভ্য করেয়া তোলা।

(১৪) শ্রমিকদের জীবনধারণের জন্য উপযোগী নিম্নতম মজুরী, চাকুরীর স্থায়িত্ব, দৈনিক উর্দ্ধে ৮ ঘণ্টা কাজ, ভবিষ্যতের নিরাপত্তা, ধর্মঘট ও যৌথ দর কষাকষির অধিকার সহ সমস্ত ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার নিশ্চিত করা।

তাদের বাসস্থান, ছুটি, পরিবার সহ শিক্ষা, চিকিৎসার বন্দোবস্ত, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও খেলাধুলার ব্যবস্থা করা।

কর্মচারী, বুদ্ধিজীবী প্রভৃতির জীবনধারণের যোগ্য আয় নির্ধারিত করা, তাদের জীবিকা ও চাকুরীর সংস্থান ও নিশ্চয়তা বিধান ও তাহাদের উপর হইতে করলাভ লাঘব করা।

শ্রমিক ও কর্মচারীদের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করা।

(১৫) সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পুরুষদের সহিত নারীদের সমান অধিকার, সমান মর্যাদা নিশ্চিত করা। সর্ববিধ সামাজিক নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণ হইতে নারী সমাজের মুক্তি নিশ্চিত করা। নারীদের ভিতর শিক্ষা প্রচারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা অবলম্বন করা।

(১৬) যাহারা পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠীর সাথে সহযোগিতা করিয়াছে কিংবা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জনগণের শত্রুতা করিয়াছে, তাদের স্থাবর ও অস্থাবর সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা এবং তাহাদিগদের শাস্তির ব্যবস্থা করা।

শত্রু সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করিয়া তাহা জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করা।

(১৭) শত্রুকর্তৃক দখলকৃত সম্পত্তি মালিকদিগদের ফিরাইয়া দেওয়া। শত্রু দ্বারা উৎখাতকৃত ব্যক্তি ও পরিবারবর্গের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।

মুক্তিযুদ্ধে নিহত ও আহতদের পরিবারবর্গকে যথোপযুক্ত সাহায্য দেওয়া।

(১৮) বৈদেশিক ক্ষেত্রে স্বাধীন ও নিরেপেক্ষ নীতি অনুসরণ করা, কোনরূপ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধজোটে শামিল না হওয়া, সকল দেশের সহিত সমতার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন, ভারত সহ আফ্র-এশিয়ার দেশসমূহ, সমাজতান্ত্রিক শিবির ও মিত্রভাবাপন্ন দেশসমূহের সহযোগিতা স্থাপন এবং শান্তিকামী দেশসমূহের সহিত এক কাতারে দাঁড়াইয়া বিশ্ব শান্তি রক্ষা ও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার নীতি অনুসরণ করা।

পশ্চিম পাকিস্তানের শোষিত জনগণ ও নির্যাতিত জাতিসমূহের ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের প্রতি সকল প্রকার সহযোগিতা ও সমর্থনের নীতি অনুসরণ করা।

সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির উপর নির্ভরশীল না হওয়া এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী শর্তযুক্ত বৈদেশিক সাহায্য বা ঋণ গ্রহণ না করা।

সংগ্রামের মাধ্যমে কোন মুক্ত অঞ্চল হইলে সেই অঞ্চলে উক্ত কর্মসূচী যথাসম্ভব বাস্তবায়িত করিতে হইবে।

Scroll to Top