গোলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিবর রহমানের কক্তৃতা

<2.97.443>

 

শিরোনাম সূত্র তারিখ
গোলটেবিল বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা দৈনিক পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পুস্তিকা ১০ মার্চ, ১৯৬৯

 

রাওয়ালপিন্ডিতে গোল টেবিল বৈঠকে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ

 

মিঃ প্রেসিডেন্ট ও ভদ্রমহোদয়গণ,

 

জাতি আজ এর ভিত্তি নড়িয়ে দেয়া ক্রান্তিলগ্নে দাড়িয়ে আছে। আমরা যারা এ দেশকে ভালবাসি এবং পাকিস্তান সৃষ্টির পিছনে বিশাল আত্নত্যাগের কথা স্মরণ করি, তাদের জন্য এ এক গভীর শঙ্কার সময়। সমস্যা সমাধানের জন্য এর স্বরূপ বোঝা এবং এর মূল চিহ্নিত করা প্রয়োজন।যে অভ্যুত্থান দেশে হয়ে গেল, তার পিছনের মৌলিক বিষয়গুলো বুঝতে পারার ব্যার্থতার থেকে আর কোন কিছুই বেশি দুর্যোগ বয়ে আনতে পারবে না। এ বিষয়গুলকে বিগত একুশ বছর ধরে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এ বিষয়গুলো মুখোমুখি হবার সময় এসেছে আজ। আমি নিশ্চিত যে আমাদের সমস্যার একটি সর্বাঙ্গীন সমাধান খুজে পাওয়া যাবে, কেননা বর্তমান পরিস্থিতি ধামাচাপা দিয়ে রাখার অবস্থা নেই। আমাদের অস্তিত্ব আজ সংকটাপন্ন।

 

এই দন্ডাদেশ আমাকে আমাদের মৌলিক সমস্যার সর্বাঙ্গীন সমাধান খুজতে বাধ্য করেছে। জনগণের বিভিন্ন অংশ থেকে উত্থাপিত দাবীসমুহ যদি সতর্কভাবে বিশ্লেষণ করা হয়, তিনটি মূল বিষয় চিহ্নিত হবে। প্রথমটি হল রাজনৈতিক অধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতার অভাব। দ্বিতীয়টি হল সমাজের এক বৃহত জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বীকার হওয়া, যাদের মধ্যে শ্রমিক, কৃষক, স্বল্প ও মধ্য আয়ের জনগণ অন্তর্ভুক্ত,যাদের ঘাড়ে আসলে উন্নয়নের মূল্য চেপে বসে মূল্যস্ফীতির আকারে, যেখানে সেই উন্নয়নের সুফল ভোগ করে অল্প কিছু পরিবার, যাদের অধিকাংশই একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বাস করে। তৃতীয়টি হল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ভিতর গড়ে ওঠা অবিচারের অনুভুতি; তারা মনে করে বর্তমান সাংবিধানিক ব্যবস্থায়, কার্যকর রাজনৈতিক শক্তির অনুপস্থিতির কারণে তাদের মৌলিক অধিকারসমুহ ক্রমাগত উপেক্ষিত থাকছে। পশ্চিম পাকিস্তানের আগের সংখ্যালঘু প্রদেশগুলোও বর্তমান সাংবিধানিক ব্যবস্থার ব্যাপারে একই মনোভাব পোষণ করে।

রাজনৈতিক অধিকারের অভাববোধ পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের উত্থাপিত ১১ দফায় স্থান পেয়েছে, সেই সাথে আওয়ামী লীগের উত্থাপিত ৬ দফা দাবিতেও সংসদীয় গণতন্ত্র, যা সকল অংশের প্রতিনিধিত্ব ও আইন বিভাগের নিরংকুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্জিত হবে এবং যার প্রতিনিধিরা সরাসরি সকল প্রাপ্তবয়স্ক জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে।

 

<2.97.444>

 

জনসংখ্যার ভিত্তিতে সকল অংশের প্রতিনিধিত্বশীল হবে এবং যার প্রতিনিধিরা সরাসরি সকল প্রাপ্তবয়স্ক জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে, 

 

অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টি শিক্ষার্থীদের ১১ দফার অর্থনৈতিক ও শিক্ষা ব্যবস্থার সুনির্দিষ্ট সংস্কার প্রস্তাবের মাধ্যমে চমৎকারভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। আমার দলের দেওয়া ৬ দফা দাবী স্পষ্টভাবেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এবং আঞ্চলিক সায়ত্ত্বশাসনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে, যা প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক সংস্কার এবং কার্যকর অর্থনৈতিক কর্মসূচী বাস্তবায়নের অত্যাবশ্যকীয় পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত।

ন্যায়বিচারের বিষয়টি পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশ ও অঞ্চলের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার দাবির মূল ভিত্তি, যা ৬ দফা দাবী এবং ১১ দফা দাবিতে সুনির্দিষ্টভাবে যুক্ত হয়েছে। এটি একইসাথে এর একটি অংশের পৃথকীকরণ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের একটি সংযুক্ত ফেডারেশনের দাবির পিছনের ভিত্তিও বটে।

 ‘Democratic Action Committee’ এই গভীর এবং সমস্যাসংকুল জাতীয় ইস্যু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। নিম্মোক্ত সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে তারা সব সময় সর্বসম্মতিক্রমে একমত পোষণ করেছেনঃ

(ক) ফেডারেল সংসদীয় ব্যাবস্থার প্রবর্তন।

(খ) সকল প্রাপ্তবয়স্কের সরাসরি ভোটে নির্বাচনের পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা ও প্রবর্তন

(গ) কমিটির সদস্যদের মধ্যে নিম্মবর্ণিত বিষয়গুলোতে ঐকমত্য লক্ষ্য করা যায়ঃ

(ঘ) এক অংশের পৃথকীকরণ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের একটি সাব-ফেডারেশন প্রতিষ্ঠা করা।

(ঙ) অঞ্চলসমুহের পূর্ন আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান।

 

কমিটি আরো সিদ্ধান্ত নেয় যে, এই বিষয়ে সদস্যেরা আরো যেকোন প্রস্তাবনা যোগ করতে পারে, কেননা কমিটি মনে করে এটি বর্তমান সমস্যার মূলতপাটন করে একটি কার্যকর এবং দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য জরুরী। যেহেতু আমরা সেই একই উদ্দেশ্যে, একটি কার্যকর এবং স্থায়ী সমাধান খুজতে এখানে একত্রিত হয়েছি,আমি এই সভায় উপস্থিত সকলকে জনসংখ্যার ভিত্তিতে সবার প্রতিনিধিত্বশীল ফেডারেল শাসনব্যাবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং শক্তিশালী, ঐক্যবদ্ধ ও প্রাণচঞ্চল পাকিস্তান প্রতিষ্টার লক্ষ্যে ৬ দফায় বর্ণিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য বর্তমান সংবিধানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের গুরুত্ব বোঝানোর সর্বাত্নক চেষ্টা করাটাকে আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব বলে মনে করি। আমি এও বলতে চাই, আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের মুক্তির জন্য লড়াই করা রাজনৈতিক দল। এর প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। আমি গর্বের সাথে স্মরণ করি যে, তার নেতৃত্বে, আমি এবং আমার কিছু সহকর্মী

 

<2.97.445>

 

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অগ্রদুতের ভূমিকা পালন করেছি। পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা এবং তা আরো শক্তিশালি করার জন্য এগুলো অত্যাবশ্যকীয়, এই বিশ্বাস থেকে আমি আজ ফেডারেল আইনসভায় গণতন্ত্রের প্রথম নীতি ‘এক ব্যাক্তি, এক ভোট’ এর ভিত্তিতে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাবনা সম্মেলনে উপস্থাপন করছি। 

৬ দফায় যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, জাতীয় ফোরামে শুধু জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় উত্থাপিত হবে। সেকারণে প্রতিনিধিরগণ পুরো বিষয়টিকে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় দেখবেন, কোন আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে নন, এবং সে কারণে ভোট প্রদানও কোন আঞ্চলিক বিবেচনায় হবে না। এছাড়াও, জাতীয় রাজনৈতিক দলসমুহ ফেডারেল আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব করবে, ফলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে দলের ভিত্তিতে, অঞ্চল নির্ভরশীল নয়। গত একুশ বছরের অভিজ্ঞতায় এটি ইতোমধ্যে স্পষ্ট যে জাতীয় পরিষদে ভোট আসলে দলের উপর ভিত্তি করেই আসে। এটি দুই অংশের সাম্যের নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে জাতীয় পরিষদ আঞ্চলিক বিষয়ে ভোট প্রদান করবে বলে মিথ্যা আশ্বাস প্রদান করা হয়েছিল। এই সমান-সমান নীতি বরং জাতীয় রাজনীতিতে আঞ্চলিকতার প্রভাবকে উস্কে দিয়েছে।বিগত একুশ বছরের ইতিহাসে এটা স্পষ্ট যে পূর্ব পাকিস্তান সব সময় জাতীয় স্বার্থে তার আঞ্চলিক স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছে, যদিও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এই অঞ্চলের বাসিন্দা।

এটি নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দিতে হবে না যে প্রথম নির্বাচিত আইনসভায় পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচিত ২৮ জন প্রতিনিধির বিপরীতে পূর্ব পাকিস্তানের ৪৪ জন নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন , কিন্তু তারপরও তারা কখনোই আঞ্চলিক স্বার্থ প্রসারে কোন ভূমিকা গ্রহণ করেননি। শুধু তাই নয়,৬ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পূর্ব পাকিস্তানের আসনে থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও  পূর্ব পাকিস্তান সমান-সমান নীতি মেনে নিয়েছিল, শুধু আইনসভায়ই নয়, বরং রাষ্ট্রের সকল স্তরে। দুঃখজনক হলেও এটি সত্য যে, আইনসভায় সমান সংখ্যা প্রতিষ্ঠার ঘটনাটি খুব দ্রুতই বাস্তবায়িত হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রের জনপ্রশাসন, সামরিক বাহিনী এবং পররাষ্ট্র সেবা সহ অন্যান্য অংশে সমান প্রতিনিধিত্বের সুবিধা থেকে পূর্ব পাকিস্তান এখনো বঞ্চিত। পূর্ব পাকিস্তান  এমনকি এটিও মেনে নিয়েছিল যে ফেডারেল সরকারের রাজধানী এবং সামরিক সদর দপ্তর দুটোই পশ্চিম পাকিস্তানে হবে। এর অর্থ হল প্রশাসনিক ও সামরিক খরচের একটি বড় অংশ, ২৭০ কোটি রুপি বা মোট বরাদ্দের ৭০% পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হয়।

আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইয়েরা যদি ফেডারেল আইনসভায় আমাদের আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্বের দাবির বিরোধিতায় অযৌক্তিক জেদ ধরে বসে থাকেন, তখন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণও রাজধানী আর সামরিক সদর দপ্তর তাদের অংশে স্থাপন এর দাবিতে অনড় হয়ে যাবে।

পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইয়েরা যদি পূর্ব পাকিস্তানের ভাইদের উপর আস্থা রেখে তাদের আনুপাতিকহারে প্রতিনিধিত্বের দাবিতে আপত্তি না জানান, তবে তা পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সম্পর্ক মজবুত করতে তা গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করবে। এ ধরনের একটি পদক্ষেপ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপনে জোরালো ভূমিকা পালন করবে। ৬ দফা প্রস্তাবে বর্ণিত ফেডারেল শাসন ব্যাবস্থা প্রবর্তন দেশে চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে একটি অত্যাবশ্যকীয় পদক্ষেপ। আমি আবার বলতে চাই, ৬ দফার মূল চেতনা হল বিশ্বে পাকিস্তানকে ১২ কোটি মানুষের এক সংঘবদ্ধ জাতি হিসেবে তুলে ধরা। এই উদ্দেশ্য ফেডারেল ..

 

<2.97.446>

 

এই উদ্দেশ্য ফেডারেল সরকারের দ্বারা পুরণ হবে যদি তাদের কাঁধে শুধু তিনটি দায়িত্ব অর্পিত হয়ঃ পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা আর মুদ্রা ব্যাবস্থা। শক্তিশালী ও সবল পাকিস্তানের উদ্দেশ্যেই ভৌগলিক বাস্তবতার নিরিখে প্রতিটি অঞ্চলকে তাদের অর্থনীতির উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠার জন্য সম্পূর্ণ আঞ্চলিক সায়ত্ত্বশাসন দিতে হবে।

আমাদের সমাজকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব আমি বলে বোঝাতে পারবো না। শিক্ষার্থীদের দেয়া ১১ দফা, যেটায় আমি সমর্থন জানিয়েছি, তাতে অর্থনৈতিক ও শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের প্রস্তাব দেয়া আছে। এই সমস্ত প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা বোধ থেকে।

তবে এখন আমি নিজেকে শুধু সাংবিধানিক পরিবর্তনের রূপরেখা প্রদানে নি্যোজিত করছি, যা মানুষে মানুষে এবং অঞ্চলে অঞ্চলে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় আবশ্যক।

বিরাজমান অর্থনৈতিক অসমতাকে আজকের এই সংকট মুহুর্তে আনার পিছনে কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দীর্ঘকালব্যাপী বিস্তৃত ভূমিকা রয়েছে। দেশে বিদেশে বহুল আলোচিত সমালোচিত ২২ পরিবার নিয়ে আমার খুব বেশি কিছু বলার নেই, ইতোমধ্যে ক্ষমতার অলিগলিতে তাদের অবাধ আনাগোনার সুবাদে তাদের অর্জিত সম্পদের ব্যাপারে অনেক কথা হয়েছে।  মনোপলি ও জনগণকে জিম্মি করে এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে আর পুজিবাদকে উৎসাহিত করা হয়েছে, যাতে মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী আর তার থেকে অনেক অনেক গুণ বেশী সংখ্যক নিপিড়ীত শ্রমিক আর কৃষকের মাঝে ফারাক শুধুই বেড়েছে। পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যালঘু প্রদেশ সমুহে নির্লজ্জ অবিচার চলেছে। 

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের পার্থক্য সবাই জানে। ১৯৫৯-৬০ সালে পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসাব করে দেখেছিলেন যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের পার্থক্য প্রায় ৬০%। পরিকল্পনা কমিশনের মধ্যবর্তী রিপোর্ট এবং অন্যান্য কাগজপত্রে এটা স্পষ্টত যে, এই পার্থক্য বেড়েই চলেছে এবং এখন এটা ৬০% এর থেকে অনেক বেশি। এই পার্থক্যের পিছনের কারণ হল দুই অংশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত অসমতা – বেকারত্বের হারে, শিক্ষার সুযোগে, চিকিৎসা ও কল্যাণ ব্যবস্থায়। কিছু উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়, যেমন পশ্চিম পাকিস্তানের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তানের ৫-৬ গুণ; ১৯৬৬ সালের হিসাব অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানে হাসপাতাল বেডের সংখ্যা ২৬.২০০ যেখানে পূর্ব পাকিস্তানে তা ৬.৯০০; ১৯৬১-৬৬ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ১৮ টি পলিটেকনিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে হয়েছে ৪৮ টি। এর সাথে সাথে , মোট সম্পদের বন্টনে অসমতা আরো বেশি – পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তর করা ছাড়াও ৮০% এর অধিক বৈদেশিক সাহায্য পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যবহার করা হয়। যার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে বিগত ২০ বছরে ১.৩৩৭ কোটি রুপি রপ্তানীর বিপরীতে ৩.১০৯ কোটি রুপী আমদানী করা সম্ভব হয়েছে, যেখানে পূর্ব পাকিস্তান একই সময়ে তার অর্জিত ১,৬৫০ কোটি রুপির বিপরীতে মাত্র ১.২১০ কোটি রুপীর দ্রব্য আমদানী করেছে। এই সমস্ত তথ্য-উপাত্ত পূর্ব পাকিস্তানের সাথে চলমান অর্থনৈতিক বৈষম্যকেই স্পষ্ট করে তোলে।  সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী স্বল্পতম সময়ে প্রদেশসমুহের মধ্যে বৈষম্য দূর করার ব্যাপারে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। বার্ষিক …

<2.97.447>

 

জাতীয় পরিষদে জমা দেওয়া বৈষম্যের উপর ১৯৬৮ সালের বার্ষিক রিপোর্টে দেখা যায় বৈষম্য বেড়েই চলেছে।

অর্থনৈতিক ব্যাবস্থাপনার কেন্দ্রীভূত পদ্ধতি তাই অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় সর্বতোভাবে ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এটি অঞ্চলগত বৈষম্য/অসাম্য দূর করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পুরণে ব্যর্থ হয়েছে। যে কারণে, যে কেন্দ্রীভুত ব্যবস্থা আমাদের ভালো কিছু দিতে ব্যর্থ হয়েছে, তা টিকিয়ে রাখার পরিবর্তে, এই সংকট মোকাবেলায় আমাদের একটি সাহসী ও সুসদুরপ্রসারী পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিৎ। ছয় দফা দাবীতে বর্ণিত ফেডারেল শাসনব্যবস্থা তেমনই একটি সাহসী ও সুদুরপ্রসারী সমাধান বলে আমি বিশ্বাস করি।

মোটা দাগে, এটি অর্থনৈতি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অঞ্চলের উপর ছেড়ে দেবার একটি প্রস্তাবনা। এ প্রস্তাবনা এই বিশ্বাস থেকে সৃষ্টি হয়েছে যে, এটি এককভাবে কার্যকরী উপায়ে সমস্যার মোকাবেলা করতে সক্ষম, যেটি আমাদের বর্তমানে প্রচলিত কেন্দ্রীভুত ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছে। দেশের অনন্য ভৌগলিক অবস্থার কারণেই, যার ফলে শ্রমের অবাধ যাতায়াত বাধাগ্রস্ত এবং একই সাথে একেক অঞ্চলে একেক শ্রেণির উন্নয়ন চলমান, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রীভুত হোয়া উচিৎ নয়।

ছয় দফায় মুদ্রা, বৈদেশিক বাণিজ্য, বৈদেশি বিনিময় উপার্জন ও কর ব্যবস্থাপনার সকল দায়িত্ব আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করার পরিকল্পনা এই প্রস্তাবনায় বিধৃত হয়েছে। মুদ্রা সংক্রান্ত বিষয়ক প্রস্তাবনা সমুহ অর্থ পাচার রোধ ও মুদ্রানীতির উপর নিরাপদ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কথা মাথায় রেখে সাজানো হয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনময় সংক্রান্ত প্রস্তাব সমুহ এক অঞ্চলের সম্পদ যেন সেই অঞ্চলেই সহজপ্রাপ্য হয় এবং বৈদেশিক উপার্জনের সিংহভাগ অংশ যেন সেই অঞ্চলের উন্নয়নে ব্যবহার করা যায়, তা নিশ্চিত করার কথা মাথায় রেখে পরিকল্পিত। করব্যবস্থা সম্পর্কিত প্রস্তাবনায় মাথায় রাখা হয়েছে ফেডারেল সরকারের রাজস্ব প্রয়োজনীয়তায় কোন ঘাটতি সৃষ্টি না করেও যেন মুদ্রা ব্যবস্থার উপর আঞ্চলিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত থাকে, তা চিন্তা করে।

এই প্রস্তাবনা সমুহের সারবক্তব্য নিম্মরূপঃ

(ক) মুদ্রার ব্যাপারে, এক অঞ্চলে থেকে আরেক অঞ্চলে অর্থ পাচার রোধ এবং মুদ্রানীতির উপর আঞ্চলিক সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মুদ্রা নীতির উপর আঞ্চলিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিতকল্পে হয় দ্বৈত মুদ্রা প্রচলনের করে অথবা একই মুদ্রার প্রতি অঞ্চলে পৃথক পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে করা যেতে পারে, যাতে কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রন থাকবে। এই ব্যবস্থা ব্যতীত অন্যান্য বিষয়ে, মুদ্রা ফেডারেল ব্যবস্থার একটী বিষয় হিসেবে পরিগণিত হবে। 

(খ) রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির কাঠামোর ভিতরে থেকে, যা ফেডারেল সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত হবে, প্রতিটি আঞ্চলিক সরকার, বৈদেশিক বাণিজ্য ও সহায়তার ব্যাপারে সরাসরি দর কষাকষি করার অধিকার রাখবে।  

(গ) প্রতি অঞ্চলের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা প্রতি অঞ্চলে স্থাপিত রিজার্ভ ব্যাংকের একটি নির্দিষ্ট হিসাবে জমা করা হবে এবং এর উপর আঞ্চলিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকবে। বৈদেশিক মুদ্রার কেন্দ্রীয় চাহিদা দুই অঞ্চলের একাউন্ট এর সমন্বয়ের মাধ্যমে করা হবে এবং তা হবে একটি পূর্ব সম্মত অনুপাতের ভিত্তিতে।

 

 

 

 

 

 

<2.97.448>

(ঘ) কর সংক্রান্ত ব্যাপারে, প্রস্তাবনা অনুসারে কর আরোপ ও আদয়ের ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের উপর ন্যাস্ত থাকবে, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার তার রাজস্ব প্রয়োজনীয়তা মেটানোর লক্ষ্যে আঞ্চলিক সরকারের আদায়কৃত কর থেকে অর্থ আদায় করার অধিকার রাখবে। এটি স্পষ্ট হওয়া দরকার যে, এটি কোনভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারকে তার রাজস্ব চাহিদা মেটাতে আঞ্চলিক সরকারের দয়ার উপর নির্ভরশীল করে গড়ে তোলা হয়নি।

আমি জোর দিয়ে বলতে চাই, মুদ্রানীতির উপর আঞ্চলিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ অক্ষুণ্ণ রেখেই কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব চাহিদা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে একটি সাংবিধানিক বিধান তৈরি করা কোন কঠিন কাজ নয়। কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার সকল অংশে, প্রতিরক্ষা সেবা সহ, জনসংখ্যার বন্টনের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সকল অংশের মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে, এই স্বপ্নও এই দাবীনামার অংশ।

যদি এই মূলনীতিগুলোতে সম্মত হওয়া যায়, তবে বিস্তারিত বিষয়গুলো নিয়ে দুই দল কর্তৃক মনোনীত বিশেষজ্ঞগণ দিয়ে গঠিত কমিটি কাজ করতে পারে।   

পাকিস্তান রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়া অর্থনৈতিক অবিচারের রাজনীতির বিষবৃক্ষ উৎপাটনে এই প্রস্তাবনা বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে, একই সাথে কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ফলে সৃষ্ট এতদিনের অবিশ্বাস ও হতাশা দূর করার ক্ষেত্রেও অগণি ভূমিকা পালন করতে পারে। আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ এই প্রস্তাবনাকে সর্বোতভাবে সমর্থন জানাবে।

আমি এই সম্মেলনে অংশ নেওয়া সকলকে খোলা মন আর বিশাল হৃদয় নিয়ে, ভাতৃত্ব আর জাতীয় সংহতির উদ্দীপনায় অনুপ্রাণিত হয়ে, সামনে এগিয়ে এসে, আপনাদের সামনে উপস্থাপিত ফেডারেল শাসনব্যবস্থা সংক্রান্ত প্রস্তাবনাকে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা – অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার, একমাত্র উপায় হিসেবে গ্রহণ করার আহবান জানাবো। বর্তমান সংকট সৃষ্টির পিছনে অর্থনৈতিক অবিচারের অনুভুতির চেয়ে আর বড় কোন কারণ নেই। আসুন, সবাই মিলে এটি দূর করি, সমস্যার গোড়ায় গিয়ে তা সমাধানের চেষ্টা করি। এই মূল সমস্যা এড়িয়ে যাবার যেকোন চেষ্টা হবে আমাদের অস্তিত্বকে সঙ্গকটের মুখোমুখি করার সামিল।

সর্বশক্তিমান আল্লাহ কিংবা ইতিহাস, কেউ আমাদের ক্ষমা করবে না যদি আমরা এই জাতীয় সংকটের মুহুর্তে এই ভয়ংকর সমস্যা, যা জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে, তা সমাধানে সাহসী পদক্ষেপ নিতে পিছপা হই। আমাদের জাতীয় সমস্যার মুখোমুখি হবার এ এক বিরাট সুযোগ আমাদের সামনে, যা আমরা পরে আর কখনো নাও পেতে পারি। সে কারণে, আমাদের সর্ব শক্তি দিয়ে সম্ভাব্য সকল উপায়ে এই সমস্যার সমাধানে ব্রতী হতে হবে। আসুন আমরা সকলে মিলে আমাদের প্রিয় পাকিস্তানকে তার বর্তমান করুণ অবস্থা থেকে টেনে তুলি এবং একটি সত্যিকারে প্রাণচঞ্চল ফেডারেল সংসদীয় ব্যবস্থার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করি, যা পাকিস্তানে সকল জনগণের জন্য সর্বোচ্চ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে।  শুধু তখনই, একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান ভবিষ্যতের পথে আশা আর আত্নবিশ্বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করতে পারবে। 

পাকিস্তান জিন্দাবাদ

১০ মার্চ, ১৯৬৯

* ১৯৬৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী প্রথম গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, দ্বিতীয় পর্যায়ের ১০ মার্চ থেকে বৈঠক শুরু হয়। 

 

আব্দুল মোমিন, প্রচার সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, ১৫,, পুরানা পল্টন কর্তৃক প্রকাশিত

Scroll to Top