আসহাবুল হক, মৌলভিগেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, চট্টগ্রাম

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্রের ১৫তম খণ্ডের ১১০ নং পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ১০ নং দলিল থেকে বলছি…

মৌলভি আসহাবুল হক

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ ভাষণের পর আমরা গ্রামে গ্রামে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা করি। চট্রগ্রামের এম, এ, হান্নান ও এম, এ, মান্নান সাহেব এবং পটিয়া জেলার আওয়ামী লীগের কর্মীদের সাথে একযোগে কাজ করে যেতে থাকি। এদিকে আনুমানিক ২১/২২ শে মার্চ তারিখের রাতে পাক বাহিনী হঠাৎ করে চট্রগ্রাম নেভাল বেইস-এর শ্রমিকদের উপর গুলি চালায়। আমরা এর প্রতিবাদে মিছিল বের করলে পাক বাহিনী বাধা দেয়। ফলে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে তিনজন পাক সেনা নিহিত হয় আর আমাদের পক্ষেও কয়েকজন নিহত ও আহত হয়। মূলত: এই ঘটনার পর থেকেই পাক বাহিনীর সাথে আমাদের সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় আমাদের প্রধান কেন্দ্র ছিলো স্থানীয় রেস্ট হাউজ। আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে এম, এ, হান্নান, এম, এ, মান্নান, জহুর আহমদ চৌধুরী, ছাত্র নেতা ইউসুফসহ আমরা অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করি।

২৬ শে মার্চ সকাল ৮ টায় আমরা ঢাকার সংবাদ জানতে পারি। পটিয়ায় এসে দেখি সেখানে লোকে লোকারণ্য। ডা: ফারুক কয়েকজন ইপিআর নিয়ে কাপ্তাই চলে যান এবং কয়েকজন পাঞ্জাবী সৈন্য হত্যা করে পুনরায় পটিয়া চলে আসেন। পাঞ্জাবী সৈন্যরা যাতে আমাদের এলাকায় প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য প্রতি রাস্তার মোড়ে চেকপোস্ট বানানোর ব্যবস্থা করে আমি ২৬ শে মার্চ সন্ধ্যায় চট্রগ্রাম শহরে চলে যাই। রেস্ট হাউজে বিভিন্ন নেতা ও কর্মীর সাথে আলোচনা করে সমগ্র শহর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যবস্থা করি এবং ক্যান্টনমেন্ট অবরোধ করি। কয়েকজন পলায়নপর পাঞ্জাবীকে ধরে হত্যা করা হয়। ঢাকা হতে বিপুল সংখ্যক সৈন্য চট্রগ্রাম আসে এবং কুমিরাতে আমরা তাদের প্রতিরোধ করি। কিন্তু তারা টিকতে না পেরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। অবশ্য দুদিন পরই সমগ্র শহর পাক বাহিনীর আয়ত্তাধীনে চলে যায়।

এরপর আমরা পটিয়াতে চলে আসি। তখন পটিয়াই ছিলো আমাদের প্রধান কেন্দ্র। ডা: মান্নান, প্রফেসর নুরুল ইসলাম চৌধুরী, মেজর জিয়া ও আমি বেতারের ট্রান্সমিটার এনে পটিয়া মাদ্রাসায় স্থাপন করি। এখান হতে মেজর হারুনের নেতৃত্বে আমরা হানাদারদের মোকাবেলা করি এবং ১২/১৪ দিন যুদ্ধ চলে। এ সংঘর্ষ চলাকালে আমি প্রধান রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় অসংখ্য লাশ দেখতে পাই। পাক বাহিনী আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং সন্তোষজনক উত্তর পেয়ে আমাকে ছেড়ে দেয়। কিন্তু ফেরার পথে একটি পাক বাহিনীর গাড়ি আমাকে উঠিয়ে মিউনিসিপ্যাল অফিসে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। কিন্তু জনৈক মেজর জিজ্ঞাসাবাদের পর আমাকে ছেড়ে দেয়। দু’দিন শহরে থাকার পর আমি পটিয়া চলে আসি। এর মধ্যে ক্যাপ্টেন হারুন আহত হলে তাকে চিকিৎসার জন্য চিরিঙ্গা পাঠানো হয়। এরপর আমি পটিয়া ক্যাম্পে কাজ করতে থাকি। ১৬ই এপ্রিল শুক্রবার সকাল আটটায় নিজ বাড়িতে যাই। এদিন দুপুর পর্যন্ত বিমান থেকে গুলি চালানো হয়। এর ফলে পশ্চিম পার্শ্বের মোড়ে কতগুলো দোকান ধ্বংস ও বেশ কিছুসংখ্যক লোক নিহত হয়। স্থানীয় মসজিদে গিয়ে দেখি মসজিদ রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে। মাদ্রাসার দু’জন মৌলভী ও কিছুসংখ্যক ছাত্র মারা গিয়েছে। কলেজেরও যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হয়।

বিজ্ঞান ভবনের পূর্বপাশে পটিয়া থানার সংগ্রাম পরিষদ নেতা অধ্যাপক ফজলুল করিম ও আরো কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে দেখা হয়। ঐ দিন কালুরঘাট হতে পটিয়া পর্যন্ত যে সমস্ত বাংলা বাহিনী ছিলো সবাই যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। আমি আশেপাশের যুবকদের একত্রিত করে আলাপ আলোচনা করি। এর পরের দিন একটা গ্রেনেড নিয়ে শহরে গমন করি এবং বিকেল তিনটায় বাসায় উপস্থিত হই। হানাদার বাহিনীর কয়েকটা ট্রাক তখন চকবাজারের দিকে যাচ্ছিল। রাত সাতটার দিকে স্টীম লন্ড্রির ছাদ থেকে আমি একটা ট্রাক লক্ষ্য করে গ্রেনেডটি ছুঁড়ে মারি। ট্রাকটি কয়েকজন হানাদার ও অস্ত্রশস্ত্রসহ সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হয়। আমি ঐ ছাদেই শোয়া অবস্থায় ছিলাম। অন্যান্য ট্রাক হতে পাক সৈন্য রাত একটা পর্যন্ত গুলি চালায়। আশপাশের সব দোকান পুড়িয়ে দেয়। তারা সরে পড়লে আমি অতি গোপনে হাঁটতে হাঁটতে সকালে পাথরঘাটা পৌঁছি। দুইদিন দুইরাত হেঁটে মিরেরশরাই পৌঁছি। তারপর অতি কষ্টে ২১ শে এপ্রিল শ্রীকান্ত সীমান্ত পার হই। সেখানে মিরেরশরাই-এর এম পি মোশাররফ হোসেনের সাথে সাক্ষাৎ হয়। এর পরের দিন ছাগলনাইয়ার প্রাক্তন এম এন এ ও সাবেক পটিয়া কলেজের অধ্যক্ষের সংঙ্গে সাক্ষাৎ করি। পরের দিন বাসে করে বেলুনিয়া যাই। সেখানে পাক বাহিনী ও আমাদের বাহিনীর সঙ্গে যে সংঘর্ষ চলছিলো তাতে আমি অংশ নেই। দুজন আহত ইপিয়ার কে নিয়ে বেলুনিয়া হাসপাতালে চিকিৎসার পর ক্যাম্পে পৌঁছিয়ে সাবরুমে যাই। সেখানে এম, এ, হান্নান, এস, এম, ইউসুফ, মির্জা মনসুর, স্বপন কুমার চৌধুরী, চট্রগ্রাম জেলা ছাত্র লীগের সভাপতি হাসেম, চট্রগ্রাম কলেজের ভিপি জামালউদ্দিন এবং সাবের আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তাদের সাথে আলাপ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে বাংলাদেশ হতে যুবকদের এনে গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হবে। সিদ্ধান্ত মোকাবেক আমরা উপস্থিত কয়েকজন লোক এবং কয়েকজন ই, পি, আর নিয়ে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করি। এ ক্যাম্প পরিচালনার জন্যে হাসেম, মন্টু, মহিউদ্দিন ও আমি রইলাম। বাকি কয়েকজন আলাপ আলোচনার জন্যে আগরতলায় চলে গেলেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে আরো কিছুসংখ্যক লোক এসে আমদের এই ট্রেনিং ক্যাম্পে যোগ দেন। এ সময় আগরতলা থেকে এস, ডি, ও ও আরো কয়েকজন সরকারী কর্মকর্তা আগমন করলে তাদের সাথে পরামর্শ করে রেশনের ব্যবস্থা করি।

কিছুদিন এভাবে ক্যাম্প চললো। কিন্তু ভারতে আগমনকারী বাঙালিদের মধ্যে সবাই শরণার্থী হিসেবে আসতো। ট্রেনিং নেয়ার লোকের অভাব উপলব্ধি করে আমি চট্রগ্রাম ও পার্বত্য চট্রগ্রামের ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগ কর্মীদের তালিকা নিয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। প্রায় ১ মাস ১৭ দিন পায়ে হেঁটে চট্রগ্রাম জেলার মিরেরশরাই থানা হতে টেকনাফ ও পার্বত্য চট্রগ্রামের রাঙ্গামাটি, মাইওনী ও ফটিকছড়ি থানায় ঘুরে ঘুরে সকল কর্মীর ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার সংবাদ দেই। এর মধ্যে দেখতে পেলাম একমাত্র মৌলভী সৈয়দ আহমেদ ও শাহজাহান ইসলামাবাদী ছোট ছোট আক্রমণ পরিচালনা করছেন। ১ মাস ১৭ দিনের ভ্রমণের মধ্যেই কয়েকজন ছাত্র নিয়ে পটিয়া তহশীল অফিস, ষোলশহর তহশীল অফিস, আনোয়ারা থানা তহশীল অফিস ও আরো কয়েকটি তহশীল অফিস জ্বালিয়ে দেয়া হয়। প্রফেসর নূর মোহাম্মদ ও ওবায়দুল্লাহ মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে আমি হরিণা ক্যাম্পে যাই। এর মধ্যে কয়েকজন যুবককে আমি ভারতে পাঠাই। কিন্তু পথিমধ্যে মিজো ও পাঞ্জাবীদের দ্বারা আক্রমণে হারুন ও ফরিদ নামক দুজন যুবক নিহত হয়। বাকী যুবকরা ভয়ে ফিরে আসে। বাংলাদেশ থেকে নিরাপদে কিভাবে যুবকদের ভারত নিয়ে যাওয়া যায় সে জন্যে মেজর রফিক, ক্যাপ্টেন এনাম, ক্যাপ্টেন মাহফুজ, এম, এ, হান্নান, সাবের, ইউসুফ, অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ প্রমুখ ব্যক্তিদের নিয়ে এক আলোচনা সভা বসে। এই আলোচনার পর মেজর রফিক আমাকে চট্রগ্রাম, পার্বত্য চট্রগ্রামসহ প্রতিটি থানার মানচিত্র নেয়ার দায়িত্ব দেন। কোঅপারেটিভ বুক সোসাইটি হতে সমগ্র চট্রগ্রামের মানচিত্র সংগ্রহ করি। প্রত্যেক সি ও এর কাছ থেকেও মানচিত্র সংগ্রহ করি এবং লোক মারফতে ওপার বাংলায় মেজর রফিকের কাছে প্রেরণ করি। এ সময় আমার খালুর সঙ্গে শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘুরাফেরা করি এবং অনেক পাক সৈন্যের সঙ্গে পরিচয় হয়। একদিন বিগ্রেডিয়ার অফিসে ঢুকে দুটো আর্মী ম্যাপ সংগ্রহ করে সেখান থেকে সরে পড়ি।

এর কয়েকদিন পর দক্ষিণ চট্রগ্রাম থেকে ৪৪/৪৫ জন ছেলে এবং উত্তর চট্রগ্রাম থেকে ৪০/৪৫ জন ছেলে সংগ্রহ করে তাদেরকে ভারতে প্রেরণ করি। আমিও ভারতে চলে আসি। সঙ্গে আনা আর্মী ম্যাপটা মেজর রফিককে প্রদান করি। যেসব ছেলে ট্রেনিং নেয়ার জন্য এসেছিল তাদের প্রতি সাতজনের একটি গ্রুপ করে মোট ৩৬ টি গ্রুপ তৈরি করি। প্রত্যেক গ্রুপে একজন কমান্ডার ছিল। তারপর মেজর রফিকসহ চট্রগ্রামকে কেন্দ্র করে তিনটি চ্যানেল খোলা হয় এবং কয়েকজন গাইড নিযুক্ত করা হয়। ফটিকছড়ির দায়িত্ব দেয়া হলো জহুরুল হককে এবং মিরেরসরাই এর দায়িত্ব দেয়া হলো নূর মোহাম্মদকে। তিনজন গাইড নিযুক্ত করা হলো এবং প্রত্যেকটি গ্রুপ হতে একজন করে কুরিয়ার নিযুক্ত করা হল। প্রত্যেক গ্রুপকে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হয় এবং সমস্ত গ্রুপের প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হলো সার্জেন্ট এ, এইচ, এম মাহি আলম চৌধুরীকে। তারপর সবাইকে শপথ গ্রহণ করানো হলো। মেজর রফিকুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এনাম, ফ্লাইট লেফটেনেন্ট সুলতান, হান্নান, অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ, রফি সাহেব, সাবের সাহেব, আজগরী, জালালউদ্দিন প্রমুখ নেতৃবর্গ এখানে উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস বানচালের প্রতিজ্ঞা নিয়ে ৩রা আগস্ট আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করি। প্রথমে পাগলাছড়িতে মিজোদের সাথে আমাদের সংঘর্ষ হয়। এতে বেশ কয়েকজন মিজো মারা যায় এবং বাকি মিজোরা পালিয়ে যায়। রাজবাড়ীতে পাক বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে ১৩ জন পাঞ্জাবী ও ২ জন মিজো মারা যায় এবং একটা জীপ ধ্বংস হয়। তৃতীয় সংঘর্ষ হয় ফটিকছড়ির বিবিরহাটে। উক্ত সংঘর্ষে সাত জন পাঞ্জাবী ও ১৪ জন মুজাহিদ মারা যায়। পাঞ্জাবীরা তখন পিছু হটতে বাধ্য হয়। রাউজান কলেজের সামনে চতুর্থ সংঘর্ষে ৫ জন পাক সেনা নিহত হয়। দুটি চাইনিজ স্টেন, তিনটি চাইনিজ রাইফেল, ৫ টি বেয়নেট এবং এক পেটি গুলিও আমরা পাই। পঞ্চম সংঘর্ষ হয় গোমদণ্ডী স্টেশনে। এই সংঘর্ষে ৪০/৪৫ জন রাজাকার নিহত হয়। হাবিলদার ফজলুও নিহত হন। কয়েকজন রাজাকারের বাড়িও পুড়িয়ে দেয়া হয়। সারোয়াতলীতে সপ্তম সংঘর্ষে ৩৫ জন রাজাকার নিহত হয়। ২০ টি রাইফেল, একটি এল, এম, জি, তিন পেটি গুলি আমরা উদ্ধার করি।

১৪ই আগস্টকে বানচাল করার জন্য আমরা ১৩ ই আগস্ট পতেঙ্গা থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত বিদ্যুৎ পাওয়ার স্টেশনের টাওয়ারগুলো নস্ট করে ফেলি। ঐদিন রাতে আমরা বিভিন্ন স্খানে ৩৬ টি মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শক্রর উপর আঘাত হানি। একই রাতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যেমন: পাহাড়তলী পাঞ্জাবী ক্যাম্প, দেওয়ানহাটের ক্যাম্প, চকবাজার ক্যাম্প, লালদীঘির পশ্চিমের স্খান, চাকতাই ক্যাম্প, কালুরঘাট ক্যাম্প, দোহাজারী ও পটিয়া ক্যাম্প, বিবিরহাট ক্যাম্প, রাউজান ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ক্যাম্প গেরিলা পদ্ধতিতে অপারেশন চালাই। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ঐ রাত্রে বিভিন্ন অপারেশনে ১২৫ জন পাঞ্জাবী, ২৩০ জন রাজাকার মারা যায়। ফলে পাঞ্জাবী, রাজাকার ও দালালরা গ্রাম ছেড়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও থানাগুলোতে আশ্রয় নেয়। দিনের বেলা তারা বিরাট দল বেঁধে গ্রামে গ্রামে গিয়ে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতো এবং মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার করতো। এই পরিস্থিতিতে আমরা পাক বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা করি। একদিন ভোর সাড়ে চারটায় আমরা থানা আক্রমণ করি। এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য পাক সৈন্যরা প্রস্তুত ছিল না। ফলে প্রায় ২০০ জন পাঞ্জাবী ও রাজাকার মারা যায় এবং থানার বহু পুলিশ ও রাজাকারকে আমরা আটক করি। বেশির ভাগকে হত্যা করা হয়। থানা থেকে ২০ পেটি বুলেট, ২৫০ টি রাইফেল, তিনটি এল, এম, জি উদ্ধার করি। এখান থেকে আমরা খরনা রেলওয়ে স্টেশনে রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করি। কিছু সংখ্যক রাজাকার নিহত হয়। বলঘাট মিলিশিয়া ক্যাম্প আক্রমণ করি এবং ১৪ জন মিলিশিয়া নিহত হয়। ৩টি চাইনিজ স্টেন, ৫টি চাইনিজ রাইফেল, ৫টি রাইফেল, ৩ হাজার বুলেট ও ২ টি রিভালবার উদ্ধার করি। কদুরখিল(?) গ্রামের রাস্তায় আমরা বেশ কয়েকটি রাইফেল উদ্ধার করি। সার্জেন্ট আলমের পায়ে গুলি লাগলে আমরা কমলাছড়ি পাহাড়ে আশ্রয় নেই। তখন গ্রুপ কমান্ডার মহসীন, শাহজাহান ইসলামাবাদীও আমার সঙ্গে ছিলেন।

কমলাছড়িতে মোস্তাক আহমদ ও পটিয়া থানার আনসার কমান্ডার আবদুল আলীমের সঙ্গে দেখা হয় এবং তাদের সঙ্গে আমি একটি বৌদ্ধমন্দিরে অবস্থান করি। সেখানে ই পি আর বাহিনীর সুবেদার মেজর টি এম আলী এবং তার অধীনে ১৫০-২০০ জন ই পি আর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোয়ান ছিলেন। কিন্তু সুবেদার আলী আমাকে বন্দী করে রাখেন। অবশ্য তিনদিন বন্দীর পর মেজর রফিকের সুপারিশপত্র পেয়ে টি এম আলী আমাকে ছেড়ে দেন।

কমলাছড়ির বৌদ্ধ মন্দিরে অবস্থানকালে আমি ধোপাছড়িতে মোখলেসুর রহমান, সুলতান আহম্মদ কুসুমপুরী পটিয়ার এম সি এ-এর নেতৃত্বে বেশ কিছুসংখ্যক ই পি আর ও স্থানীয় যুবক ও ছাত্রদের দুটি গ্রুপ নিয়ে অবস্থানের সংবাদ শুনি। তাজউদ্দিন সরকারের নির্দেশ মোতাবেক কুসুমপুরীকে ভারতে যেতে অনুরোধ করি। কিন্তু ব্যবসা সংক্রান্ত কারণে তিনি যেতে অস্বীকার করেন। তখন বাধ্য হয়ে আমি কমলাছড়িতে ফিরে আসি। সার্জেন্ট আলমকে চিকিৎসার জন্য কমলাছড়িতে রেখে আমি শাহজাহান ইসলামাবাদী, মহসীন আবুল হোসেন প্রমুখদের নিয়ে পটিয়ার দিকে আসি। পটিয়ার রেলস্টেশনের কাছে রাজাকার ঘাঁটিতে আমাদের সঙ্গে রাজাকারদের সংঘর্ষ বাধলে ৩ জন রাজাকার নিহত হয়। সেখান থেকে তিনটা রাইফেল, একটা এল, এম, জি, তিনটা মাইন উদ্ধার করি। তাছাড়া প্রায় ৩ হাজার গুলিও আমরা পাই। অপারেশন শেষ করে একটা দলসহ আমি আমার নিজ গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করি কিন্তু আমরা গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার একদিন পর পাকসেনার গৈরিলা গ্রামখানা জ্বালিয়ে দেয়। তাছাড়া বলঘাটে রাজাকার মুজাহিদ ও পাক ফৌজ অকথ্য অত্যাচার চালায়। বলঘাটবাসীদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে আমরা তাই বলঘাট রেলওয়ে স্টেশনের পাঞ্জাবী ঘাঁটি আক্রমণ করি। স্টেশনে আগত শেষ ট্রেনটি আমরা যাত্রীদের নামিয়ে পুড়িয়ে দেই। তারপর ঘাঁটির উপর অবিরাম গুলি বর্ষণ করি। পাক ফৌজের ঘাঁটি থেকে আমরা জি-৩ গান, ২৭ টা স্টেনগান, ৩ টা এল এম জি, ১১ টি রাইফেল, ৩ টি রিভলবার ও ৭ হাজার গুলি উদ্ধার করি। এখান থেকে নিজ গ্রামে যাই। গ্রামের কয়েকজন দালাল পটিয়া থেকে পাঞ্জাবী ডেকে গ্রামখানা ঘেরাও করে। আমরা পালিয়ে যাই এবং আরাকান রোডের পাশে গোপনে অবস্থান নেই। পাকবাহিনী সে পথে যাওয়ার সময় আমরা গুলি করি। এখানে ভীষণ যুদ্ধ হয় এবং বাম হাতে গুলি লাগলে আমি আহত হই। সার্জেন্ট আলম এ আক্রমণের নেতৃত্ব দেন। এ আক্রমণের পর আমরা পটিয়ার জিরি গ্রামে চলে যাই। জিরি গ্রামে এসে দেখতে পেলাম পশ্চিম আনোয়ারা থানার গ্রামাঞ্চলে রাজাকার, আলবদর ও পাকফৌজের নিদারুণ নির্যাতনে জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। তখন সার্জেন্ট আলম সাহেবের নেতৃত্বে পশ্চিম পটিয়ায় অপারেশন চালানোর পরিকল্পনা নেই। এ সময় ভারত থেকে ৪০ জনের একটি ফ্রগম্যান গেরিলা বাহিনী মেজর রফিক ও এম এ মান্নান সাহেবের দু’খানা পত্র নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করে। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে আমরা চর লইক্ষ্যা চাকতাই হতে পতেঙ্গার বঙ্গোপোসাগরের মোহনা পর্যন্ত যেসব স্টিমার ও জাহাজ ছিল সেগুলো মাইন দিয়ে ধ্বংস করার পরিকল্পনা নেই। পরিকল্পনা মোতাবেক ফ্রপম্যানদের দিয়ে মাইন লাগিয়ে স্টীমার ফাটিয়ে দিলে পাকবাহিনী বেপোরোয়া ভাবে গুলি চালায়। আমরাও এর জবাব দেই। এভাবে ১১ দিনে আমরা ৫টি জাহাজ ধ্বংস করতে সক্ষম হই।

স্বাক্ষর/-
হাফেজ মৌলভী আসহাবুল হক
গ্রামঃ নাইখাইল, ডাকঘরঃ গৈড়লা
পটিয়া, চট্টগ্রাম
মে, ১৯৭৩

Scroll to Top