অঘোষিত যুদ্ধ শুরু

অঘোষিত যুদ্ধ শুরু

 

নভেম্বর নাগাদ ভারতের তিনটি কোরের অধীনে সাতটি পদাতিক ডিভিশন যুদ্ধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। কুম্ভীগ্রামের ঘাঁটি পুনরায় চালু করা হয় এবং নৌবাহিনীর ইস্টার্ন ফ্লীটকে সক্রিয় করা হয়। যেকোনো আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য তাদের ব্যাপক পরিকল্পনা তখন চূড়ান্ত।

 

ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব ফ্রন্টে পাকিস্তানের সকল দুষ্কর্মের উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল। এসময়ই ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বেলুনিয়া পুনর্দখল করার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। একই সঙ্গে অন্যান্য সেক্টরেও অনুরূপ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বেলুনিয়া ৫ই নভেম্বর আক্রমণের(ডি-ডে) নির্ধারিত হয়।

 

কিন্ত ৪ঠা নভেম্বর এক মর্মান্তিক ঘটনায় আমরা সকলেই বিচলিত হয়ে পড়ি। আমার অন্যতম সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা সেদিন রাত সাড়ে৮টায় মারা যান। বেলুনিয়া অভিযানে তিনটি কোম্পানীকে তার নেতৃত্বে রাখার পরিকল্পনা ছিল। অকুতোভয় যোদ্ধা হিসেবে সৈন্যরা তাকে ভালোবাসতো, প্রশংসা করতো। আমি নিজেও দেখেছি কি নির্ভীকভাবে রণাঙ্গনের অগ্রবর্তী এলাকায় তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।এরুপ একজন অফিসারকে দেখলাম তাঁর ক্যাম্পের মধ্যে পড়ে আছেন, প্রাণহীন নিস্পন্দ। জায়গাটি রক্তে ভেসে গেছে, মাথার খুলী ছিন্নভিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে চারদিকে ছড়ানো।কয়েক মিনিট আগেও তিনি তাঁর সৈন্যদের সাথে কথা বলেছেন, পরের দিনের অভিযান সম্পর্কে কয়েকটি চূড়ান্ত নির্দেশ দিয়েছেন। যতদূর জানা যায়,বাড়ি থেকে তাঁর খুব খারাপ খবর এসেছিলো। বিগত কয়েকমাস ধরে আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে যুদ্ধ করছিলাম।অনিশ্চয়তাও হতাশায় মনোবল ঠিক রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো কিছু লোকের পক্ষে। আমার সেক্টরে বাড়িঘর নিয়ে কিংবা পারিবারিক কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলাম। খুবই নিষ্ঠুর আদেশ সন্দেহ নেই, কিন্ত সৈনিকগণের উপর খারাপ আবেগ সৃষ্টি করতে পারে এমন ধরণের কথাবার্তা থেকে বিরত রাখার জন্যই এটা করতে হয়েছিলো। আমাদের দুর্ভাগ্য৪ঠা নভেম্বর রাত সাড়ে৮ টায় ক্যাপ্টেন শামসুল হুদাকে তার বিছানায় বসে কি যেন চিন্তা করতে দেখা যায়।সীমাহীন এক অবসাদ তাকে পেয়ে বসেছিল।একসময় আপনার অজান্তেই তিনি স্টেনগান হাতে তুলে নিয়ে নলটি নিজের চিবুকে ঠেকান।তারপর যন্ত্রচালিতের মত ট্রিগার চালান।

 

বেলুনিয়া অভিযান নিয়ে আমি তখন ভারতীয় বিগ্রেড কমান্ডারের সাথে আলোচনা করছিলাম।খবর পেয়ে প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি।কিন্ত কঠিন বাস্তবতাকে একসময় স্বীকার করে নিতেই হল।আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয় যে পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামীকালই অভিযান শুরু হবে।পুরো একটা জাতির ঘোর দুর্দিনে ব্যক্তিজীবনের ট্রাজেডিগুলো আমরা শুধু মনে মনে রাখতে পেরেছি, আর কিছু করতে পারিনি সেদিন।

 

নিয়মিত পদাতিক বাহিনী এবং মিলিশিয়া নিয়ে বেলুনিয়ায় পাকিস্তানের শক্তি ছিল দুই ব্যাটালিয়নের মত।ব্যাটালিয়ন ছিল উত্তর অংশ এবং বাকি অংশ ছিল দক্ষিণভাগে।শক্তিশালী ব্যাংকার তৈরি করে এবং বেশ বিস্তৃত এলাকাজুড়ে মাইন পেতে তারা অবস্থান গ্রহণ করেছিলো। এসমস্ত অবস্থান সম্পর্কে সন্ধান না নিয়ে আক্রমণ চালালে অহেতুক লোকক্ষয় হতে পারে। কোনভাবে উত্তর অংশের শত্রুদলকে বাকী অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিচ্ছিন্ন অংশের সাহায্য সহযোগিতা বন্ধ করতে পারলে পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। আত্মসমর্পণ না করলেও কয়েকদিনের মধ্যে তাদের নির্মূল করা সম্ভব হবে। আমরা তাই সিদ্ধান্ত নেই উত্তরের এবং দক্ষিণের মাঝামাঝি কোন স্থানে অতি সন্তর্পণে রাত্রির অন্ধকারে নিঃশব্দে অবস্থান গ্রহণ করবো। ট্রেঞ্চ এবং ব্যাংকার গড়ে তুলবো রাতারাতি। এবং পরদিন সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়লেই পাকিস্তানীরা দেখতে পাবে তাদের উত্তরের অংশ দক্ষিণের বাহিনী থেকে হয়ে পড়েছে বিচ্ছিন্ন। মাঝখানে বসে আছে তাদের যমদূত মুক্তিসেনারা।

 

নভেম্বর ৪ তারিখ। অন্ধকার এবং শীতের রাত।কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। ক্যাম্প ছেড়ে বেলনিয়া অভিযানে এগিয়ে চলে মুক্তিসেনাদের দল।সৈন্যদের দীর্ঘসারি যাত্রা শুরু করতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়।বৃষ্টির সাথে বাতাসের বেগও বেড়ে যায়। হাড়কাঁপানো শিতে আমাদের ঠোঁট কাঁপছিলো। আমরা পশ্চিমদিকে এগিয়ে চলি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কষ্ট হলেও বস্তুত আমাদের সুবিধাও ছিল যথেষ্ট। আবহাওয়া খারাপ দেখে সে রাতে শত্রুদের টহলদাররা আর বাইরে বেরোয়নি।তারা ধারণাও করতে পারেনি এই রাতটিকেই আমরা বেছে নেবো।দমকা বাতাসের গর্জনে আমাদের চলাফেরা এবং ট্রেঞ্চ খোঁড়ার আওয়াজ তলিয়ে যাচ্ছিলো। ভোর হতে না হতেই আমাদের সবগুলো কোম্পানী যার যার জায়গায় পৌঁছে প্রতিরক্ষামূলক ট্রেঞ্চে অবস্থান গ্রহণ করে। আমরা তখন শীতে প্রায় জমে যাচ্ছিলাম। কিন্ত একটু পরেই বৃষ্টি থেমে গিয়েই পরিষ্কার সূর্যালোক চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

 

দেরি না করে আমরা শরণার্থী শিবির এবং গ্রাম থেকে লোক নিয়ে সাজ সরঞ্জাম বহনের ব্যবস্থা করি। যানবাহন চলাচলের জন্য পাহাড় এবং ধানক্ষেতের ভেতর দিয়ে চার মাইল দীর্ঘ রাস্তার ব্যবস্থা আমাদের করতে হয়।হাজার হাজার লোক স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিন রাত কাজ করে চলে। তিনদিনের মাথায় রাস্তাটি যানবাহন চলাচলের উপযোগী হয়ে উঠে। আমাদের সাহায্য করার জন্য বেসামরিক লোকদের মধ্যে অভূতপূর্ব সাড়া লক্ষ্য করি। ফলে আমাদের মনোবল বেড়ে যায় বহুগুণ।

 

একজন অধ্যাপক ব্যাংকারের জন্য সি, আই সিটের বোঝা মাথায় বহন করে চার মাইল পথ অতিক্রম করে টিনগুলো যথাস্থানে নামিয়েই আবার তিনি পেছন দিকে দৌড়ে গেছেন আরেকটা বোঝা আনতে। ছয় বছরের একটি ছেলেকে দিয়ে কোন কাজ করানো হবেনা বলাতে সে সেদিন কেঁদে ফেলেছিল।

 

আমাদের অবস্থান গ্রহণ করায় শত্রুদের মধ্যে তেমন কোন ত্বরিত প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলাম না। তার হয়ত ভেবেএটাওমুক্তিফৌজের অ্যামবুশ ধরণের কিছু একটা হবে তারা মুক্তিবাহিনীকে হঠিয়ে দেওয়ার জন্য একটা কোম্পানী পাঠায়। কিছুক্ষণের সংঘর্ষে ২৯ জন শত্রুসেনা নিহত হয় এবং অন্যরা উপায়ান্তর না দেখে পালিয়ে যায়। এমনকি তারা লাশগুলোও নিতে পারেনি ৭ই নভেম্বর ২টি সাবর জেট সারাদিন আমাদের অবস্থানের উপর স্টাপিং করে। এতে আমাদের টিন বহনকারী একজন বেসামরিক লোক নিহত হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার শত্রুরা তেমন ব্যাপক আক্রমণ করতে আসছিলনা। তাছাড়া, উত্তর অংশে পাকিস্তানীদের আমরা যেভাবে ঘিরে ফেলেছিলাম সেখান থেকে তাদের মুক্ত করারও তেমন কোন চেষ্টাও করছিলোনা আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম পাকিস্তানীরা এতদিনের আক্রমণাত্মক ব্যবস্থার পরিবর্তে এখন আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। এসময়ে বেলুনিয়ায় পাকিস্তানীদের একটি অয়ারলেস বার্তা ইন্টারসেপ্ট করি। সেটা ছিল,’’ বেলুনিয়া থেকে নিজেরাই পালাবার ব্যবস্থা কর।‘’

 

কয়েকজন শত্রুসেনা আমাদের ব্যূহ ভেদ করে পালানোরও চেষ্টা করেছিল কিন্ত তারা আমাদের গুলিতে নিহত হয়। ১১ই নভেম্বরের মধ্যে আমরা অবশিষ্ট শত্রুসেনাকে ধ্বংস করে ফেলি। বেশকিছু পাকিস্তানী আমাদের হাতে বন্দী হয়।

 

যুদ্ধবন্দীদের কাছ থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দুর্ভাগ্যের কথা জানতে পারি। সর্বত্রই শত্রুসৈন্যদের একটা সাধারণ অভিযোগ ছিল যে, অফিসাররা তাদের সাথে ফ্রন্টলাইনে থাকতো না। শুধু গোলাগুলি ছাড়া অন্যসব কিছুরই অভিযোগ ছিল।তাদের তিক্ত অভিযোগঃ “মনকি খাদ্যের জন্যও আমাদের ব্যবস্থা করতে বলা হতো।” প্রতিটি সেক্টরে যুদ্ধবন্দীর কাছে এবং মৃত সৈনিকদের পকেটে অনেক চিঠি পাওয়া গেছে। এগুলো পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের বাবা, মা, আত্মীয়স্বজনদের কাছে লেখা। এসব চিঠিতে তাদের করুণ অবস্থা এবং প্রতিটি স্তরে শৃঙ্খলার কাঠামো ভেঙ্গে পড়ার এক করুণ চিত্র পাওয়া যায়। এই ছিল তাদের সাফল্য- মাসে পর মাস দস্যুবৃত্তি,পাশবিক অত্যাচার এবং যাবতীয় জঘন্য অপরাধের উপযুক্ত পুরষ্কার। একজন সিপাই তার বাবাকে লিখেছেঃগতমাসে এগারোশত টাকা পাঠিয়েছি, বোধহয় পেয়েছেন। দুদিন যাবৎ এক অজ্ঞাতস্থান অভিমুখে আমরা চলেছি। গতকাল মুক্তিবাহিনীর হামলার মুখে পড়েছিলাম।এতে আমাদের প্লাটুনের দুজন মারা গেছে। এর আগে খালের পানিতে পড়েও একজন মারা যায়। এখানে ভীষণ বৃষ্টি হয়। যেদিকে তাকাই সেদিকেই শুধু বড় বড় নদী আর পুকুর।

 

লোকজন ভয়ে আমাদের কাছে ঘেঁষতে চাননা। গ্রাম থেকে আমরা খাবার সংগ্রহ করি, কিন্ত এর জন্য কোন দাম দেইনা। আমাদের অফিসাররাও কোন দাম দেয়না। আমরা এখন একটি গ্রামে বিশ্রাম নিচ্ছি। কালসকালেই আবার রওনা হতে হবে। রাতে চলাফেরা করতে পারিনা। এখানে অনেক মুক্তিফৌজ। আমি পশ্চিম পাকিস্তানে বদলী হওয়ার জন্য দরখাস্ত করেছি। আমার জন্য দোয়া করবেন।‘’

 

পরেরদিন ভোরই মুক্তিবাহিনী এই প্লাটুনটি অ্যামবুশ করে। ফলে দলের আরও দশজন সৈন্য মারা যায়।নিহত একজনের পকেটেই চিঠিটি পাওয়া গিয়েছিলো।

 

আমরা বেলুনিয়া অভিযানের আয়োজন করেছিলাম ৪ঠা নভেম্বর। অর্থাৎ এই তারিখ থেকেই সীমিত এবং স্থানীয় পর্যায়ে হলেও ভারতীয়রা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়। আর ৫ই নভেম্বর শুরু হয়ে যায় ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যকার অঘোষিত যুদ্ধ।

Scroll to Top